দক্ষিণের পর উত্তরে ভয়াবহ বন্যার শঙ্কা

ফারাক্কার ১০৯ গেট খুলে দিলো ভারত

প্রকাশ : ২৭ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

ভারতের উজানের পানির প্রবল স্রোত ও টানা বৃষ্টিতে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার মানুষ বন্যায় ভাসছেন। চলমান বন্যা পরিস্থিতির মধ্যেই ফারাক্কা ব্যারাজের ১০৯টি গেট খুলে দিয়েছে ভারত। এতে খুব শিগগিরই উত্তরাঞ্চলে বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। উপকূলীয় ও দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের মতো চরম দুর্ভোগে পড়তে যাচ্ছেন উত্তরাঞ্চলের মানুষ।

উত্তরাঞ্চলে কিছুদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে, বৃষ্টির পানিতে স্থানীয় নদ-নদী ভরপুর। এরমধ্যেই ফারাক্কার গেট খুলে দেয়ায় ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। গতকাল সোমবার ফারাক্কার ১০৯টি গেট খুলে দেয়া হয়, ফলে একদিনে বাংলাদেশে ১১ লাখ কিউসেক পানি প্রবাহিত হবে। বাঁধ খুলে দেয়ার ফলে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও বাংলাদেশে বন্যার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ভারতের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, বন্যা পরিস্থিতি ও পাহাড়ি ঢলের তথ্য বাংলাদেশকে আগে থেকেই দেয়া হয়েছে।

ফারাক্কা ব্যারাজ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রতিবেশী রাজ্যগুলোতে বন্যার কারণে পানির চাপ বেড়েছে। তবে, নেপাল থেকে এখনো পাহাড়ি ঢল আসেনি, যা কিছুটা স্বস্তির বিষয়। ফারাক্কা ব্যারাজ এলাকায় পানি বিপৎসীমার ৭৭ দশমিক ৩৪ মিটার উপর দিয়ে বইছে, তাই বাধ্য হয়ে গেটগুলো খুলতে হয়েছে। ফিডার ক্যানেলেও পানি বৃদ্ধি করা হয়েছে।

ফারাক্কা ব্যারাজের জেনারেল ম্যানেজার আর দেশ পাণ্ডে বলেন, ব্যারাজ কর্তৃপক্ষ সবসময় সতর্ক থাকে এবং নিয়মিত নজর রাখছে। পানির চাপ দ্রুত বেড়ে যাওয়ার কারণে সব ১০৯টি গেট খুলতে না দিলে ব্যারাজের ওপর বড় চাপ পড়তে পারত, যা বড় ক্ষতির কারণ হতে পারত। বর্তমানে ফিডার ক্যানেলে ৪০ হাজার কিউসেক ও ডাউন স্ট্রিমে ১১ লাখ কিউসেক পানি ছাড়া হয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) মো. ময়েজ উদ্দিন বলেন, গত রোববার পর্যন্ত ফারাক্কার ২৭টি গেট খোলা ছিল। গতকাল সোমবার বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখলাম মোট ১০৯টি গেট খোলা হয়েছে। এভাবে হঠাৎ এতগুলো গেট খুলে দিলে এ অঞ্চলে বন্যার আশঙ্কা রয়েছে।

এদিকে ভারতের উজানের ঢলে চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফেনী জেলাসহ ১১ জেলায় বন্যা হয়। এতে অর্ধকোটি বানভাসি মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বন্যাকবলিত এলাকার গবাদিপশু হারিয়ে অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়েছেন। ভয়াবহতায় মানুষ দুর্বিষহ দিন পার করছেন। থমকে গেছে তাদের জীবনযাত্রা। বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ হয়ে অন্ধকারে কাটছে সময়। ডুবে গেছে রান্নার চুলা, ফলে রান্নাবান্নাও বন্ধ হয়ে গেছে অনেকের। খাবার ও পানির সংকটে পড়েছেন বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ। খাদ্য ও বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট। রাস্তা-ঘাট তলিয়ে থাকায় ভেঙে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। বন্যাদুর্গত এলাকার অনেকে গবাদিপশু নিয়ে উঁচু বাঁধ ও পাকা সড়কে আশ্রয় নিয়েছে।

জানা গেছে, বন্যাকবলিত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ ও বিভিন্ন ধরনের পণ্যসামগ্রী দিয়ে সহযোগিতা করছে সরকারি, বেসরকারি সংস্থা ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো। পানিবন্দি লোকজনকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিতে একযোগে নৌবাহিনী, সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, কোস্ট গার্ড, ছাত্র প্রতিনিধি, বিজিবি ও জেলা প্রশাসন কাজ করছে।

স্থানীয় বাসিন্দরা বলছেন, স্মরণকালে এমন বন্যা দেখেনি ফেনী ও কুমিল্লার বাসিন্দারা। অনেক গ্রামে বাড়িঘর খালি পড়ে আছে। বেশিরভাগ ভবনের নিচতলায় পানি ঢুকেছে। কেউ কেউ দোতলা ও তিন তলায় আশ্রয় নিয়েছে। ভেসে গেছে বেশিরভাগ পুকুর ও জলাশয়ের মাছ। ঢাকা-চট্টগ্রাম-ফেনীর বিভিন্ন অংশে কোথাও হাঁটু সমান আবার কোথাও বুক সমান পানি। বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের অভাবে অনাহারে দিন কাটছে অনেকের। ত্রাণের অপেক্ষায় দিন কাটছে কারো কারো। ভারত থেকে আসা পানি ও কয়েক দিনের টানা বর্ষণে বাঁধ ভেঙে লোকালয় প্লাবিত হয়েছে।

দেশের চলমান বন্যা পরিস্থিতি ১১ জেলায় সীমাবদ্ধ আছে বলে জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। চলমান বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সোমবার সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান সাংবাদিকদের বলেছেন, বন্যায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৫৭ লাখ ১ হাজার ২০৪ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানিবন্দি পরিবার ১২ লাখ ৩৮ হাজার ৪৮টি।

ত্রাণ সচিব বলেন, ভয়াবহ বন্যায় এ পর্যন্ত মারা গেছে ২৩ জন। এর মধ্যে কুমিল্লায় ৬ জন, ফেনীতে একজন, চট্টগ্রামে ৫ জন, খাগড়াছড়িতে একজন, নোয়াখালীতে ৫ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একজন, লক্ষ্মীপুরে একজন এবং কক্সবাজারে তিনজন মারা গেছেন।

কামরুল হাসান বলেন, এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৮৩৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে ৪ লাখ ৬৯ হাজার ৫২৩ জন আশ্রয় নিয়েছেন। গত দুই দিনে নতুন করে আর কোনো ত্রাণ বরাদ্দ দেয়া হয়নি। আগের বরাদ্দ করা ত্রাণ সুষ্ঠুভাবে বণ্টন করা হচ্ছে।

দুর্যোগ ও ত্রাণ সচিব বলেন, ১১ জেলায় ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসাসেবা দিতে মোট ৬৪৫টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে। ফেনীতে স্বাস্থ্যসেবা দিতে ফিল্ড হাসপাতাল প্রস্তুত করা হয়েছে। সেনাবাহিনী ও জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের চিকিৎসকরা সেবা দিচ্ছন। পাশাপাশি স্থানীয় ক্লিনিক, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্যার্তদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকরা নির্দেশনা দিয়েছেন। সচিব বলেন, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলে সহায়তা দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে কামরুল হাসান বলেন, যারা ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হয়ে প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে সহায়তা (চেক/পে-অর্ডার/ব্যাংক ড্রাফ্টের মাধ্যমে) দিতে চান তারা প্রধান উপদেষ্টার পক্ষে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার কাছেও তা দিতে পারেন। সরকারি ছুটি ছাড়া প্রতিদিন বিকাল ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টার কার্যালয়ে এই সহায়তা নেয়া হবে।

যারা ত্রাণ তহবিলে সহায়তা (চেক/পে-অর্ডার/ব্যাংক ড্রাফ্ট এর মাধ্যমে) দিতে ইচ্ছুক তাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব অঞ্জন চন্দ্র পাল (মোবাইল-০১৭১৮-০৬৬৭২৫) এবং সিনিয়র সহকারী সচিব শরিফুল ইসলামের (মোবাইল-০১৮১৯২৮১২০৮) সঙ্গে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব।

কমছে পানি বাড়ছে দুর্ভোগ : মৌলভীবাজারের সবক’টি নদীর পানি এখন বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে মৌলভীবাজার জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে পানি কমলেও বাড়ছে মানুষের দুর্ভোগ। মনু ও ধলাই নদীর ভেঙে যাওয়া দুটি স্থানের বাঁধ মেরামত কাজ শুরু করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।

মৌলভীবাজার সদর, রাজনগর, কুলাউড়া ও কমলগঞ্জ উপজেলার অধিকাংশ উঁচু স্থানের পানি সরে গেছে। এতে অনেকের বাড়ি ঘর থেকে বন্যার পানি নেমে যায়। দেখা গেলো বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনরা বাড়িঘরে ফিরছেন। অনেকে আবার বন্যায় ধসেপড়া ঘরবাড়ি মেরামতের কাজ করছেন। সেই সঙ্গে ঘরের ভিতর আটকে থাকা কাদা পানি সরাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন অনেকে। বন্যার পানি কমলেও তাদের দুর্ভোগ বেড়েছে। মৌলভীবাজারের মতোই চট্টগ্রাম, ফেনী ও কুমিল্লাসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে।

সদর উপজেলার মাইজপাড়া এলাকার দিনমজুর রিপন বলেন, তৃতীয় দফা বন্যায় তাদের এলাকায় ৮ থেকে ৯ ফুট পানি উঠেছিল। নদীর পানি ছিল প্রায় ঘরের চালের সমান। গেলো দুই দিনে এসব পানি সরে গেছে। এখন ঘরে ফিরছি।