ঢাকা ১০ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বানভাসিদের মানবেতর জীবনযাপন

* বন্যায় মৃত্যু ২৭ জন * বন্যায় ফসল ও সড়কের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি * আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষের ঠাসাঠাসি * পানি কমায় সহজ হয়েছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ত্রাণ পৌঁছানো
বানভাসিদের মানবেতর জীবনযাপন

ভারতের উজানের ঢল ও বৃষ্টিপাত কমায় নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে এখনো লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। বেশি দুর্ভোগে রয়েছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ। কেউ আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাসাঠাসি করে, কেউবা পরিবার ও গবাদি পশু নিয়ে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকটে বানভাসি মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বন্যায় ফসলের ও সড়কের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তবে বন্যার পানি কমায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে ত্রাণ পৌঁছানো সহজ হয়েছে। চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা ও লক্ষ্মীপুর জেলায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। বন্যার পরিস্থিতির কারণে লোকজন ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্র ও স্বজনদের বাড়ি উঠেছেন। অনেকে আবার কষ্ট করে হলেও অবস্থান করছেন বাড়িতে। চারিদিকে পানি থাকায় খাটের ওপর থাকছেন, আর সেখানেই চলছে রান্নাবান্না। কোমর পানিতে যাতায়াতে অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছে এসব মানুষকে। এছাড়া সুপেয় পানিরও অভাব দেখা দিয়েছে। গরু-ছাগলসহ গবাদি পশু নিয়েও বিপাকে রয়েছেন গৃহস্থরা।

দেখা গেছে, বন্যার্তদের সহযোগিতা করতে বিএনপি, জামায়াত ইসলামী, শিক্ষার্থী, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও বিত্তশালীরা এগিয়ে এসেছে মানুষের উপকারে। বিভিন্নজন থেকে অর্থ ও খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহ করে খাবারের ব্যবস্থা করছে আশ্রয় নেয়া মানুষের জন্য। ভলান্টিয়াররা রাত-দিন পরিশ্রম করছেন। খাবার প্যাকেজিং করছে। কেউ ট্রাকে করে নৌকা করে পৌঁছে দিচ্ছে। আবার বিভিন্ন জায়গায় চুলা বসিয়ে আয়োজন করা হয়েছে রান্না-বান্নার।

ধীরে ধীরে ১১ জেলা থেকে নামছে বন্যার পানি। পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুটে উঠছে ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন। দুর্গম যেসব এলাকায় এত দিন যাওয়া সম্ভব হয়নি সরকারি-বেসরকারি ত্রাণকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবীদের, এখন সেসব এলাকায় পৌঁছাচ্ছেন তারা। তবে ত্রাণের জন্য হাহাকার সবখানে। বন্যায় ক্ষতির এমন চেহারা প্রায় সবখানে। পুকুরসহ মাছের ঘেরগুলো ভেসে গেছে, নষ্ট হয়েছে কৃষকের মাঠের ফসল, ব্যবসায়ীদের দোকানে পানি ঢুকে নষ্ট হয়েছে সব মালপত্র, ঘরের কোনো আসবাবপত্র আর ব্যবহারযোগ্য নেই। এই পরিস্থিতি এখন ফেনী, নোয়াখালীসহ আশপাশের জেলায়।

ফেনী এলাকার বাসিন্দা কাজল সরকার বলছেন, কয়েক দিনের পানিতে বাসার দোতলা থেকে চতুর্থ তলায় বাসিন্দারাসহ ৪০ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন। এমন প্রতিবেশীও প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয়ে ছিলেন যাদের তিনি আগে চিনতেনও না। পানি ছিল ভীষণ ঠান্ডা। এখন পানি মোটামুটি নেমে গেছে। তবে নিচতলার ভাড়াটিয়া কোনো কিছুই সরাতে পারেননি। তার সব সম্পদ পানিতে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। এমন অবস্থা শহরের একতলা বা টিনশেডসহ সাধারণ ঘরে যারা ছিলেন তাদের সবার। এসব মানুষ সব হারিয়েছেন।

সরেজমিন বন্যাকবলিত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছেন। প্রতিটি বাড়িতে ৩ থেকে ৫ ফুট জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। নিচু এলাকাগুলোতে জলাবদ্ধতা দেখা গেছে ৬ থেকে ৭ ফুট। বন্যার পানির কারণে নিকটস্থ আশ্রয় কেন্দ্র, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে অবস্থান নিয়েছেন বাসিন্দারা। কাপ্তাই হ্রদের পানির স্তর চূড়ান্ত বিপদসীমায় পৌঁছেছে। এ জন্য পানি বেড়ে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের তথ্য মতে, কাপ্তাই হ্রদের পানির ধারণ ক্ষমতা ১০৯ মিন সি লেভেল (এমএসএল)। হ্রদে পানি রয়েছে ১০৮.৯২ এমএসএল। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বাঁধের ১৬টি জলকপাট দিয়ে ছয় ইঞ্চির পরিবর্তে সকাল থেকে এক ফুট করে ১৮ হাজার কিউসেক পানি কর্ণফুলি নদীতে গিয়ে পড়ছে। জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক এটিএম আব্দুজ্জাহের জানান, উজানে বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় হ্রদের পানি ছাড়ার পরও পানি বাড়ছে। তাই সকাল থেকে স্পিলওয়ের গেট ছয় ইঞ্চির পরিবর্তে এক ফুট করে ১৮ হাজার কিউসেক পানি কর্ণফুলি নদীতে গিয়ে পড়ছে। যদি পানি এভাবে বাড়ে তাহলে পানি ছাড়ার পরিমাণ বাড়ানো হবে। জেলা প্রশাসনের তথ্য, জেলার রাঙামাটি সদর, লংগদু, বরকল, নানিয়ারচর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের প্রায় ১৮ হাজার মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। যারা আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছেন তাদের রান্না করা খাবার দেয়া হচ্ছে। সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার রিফাত আসমা জানান, রাঙামাটি পৌরসভা এলাকায় ১২ মেট্রিক টন এবং উপজেলা সদরে ছয়টি ইউনিয়নে ১৮ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যা ইউপি চেয়ারম্যান ও পৌরসভার কাউন্সিলরা বিতরণ শুরু করেছেন। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান বলেন, পানিবন্দি মানুষের জন্য খাদ্য সহায়তা দেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে বাঁধের পানি ছাড়া অব্যাহত রয়েছে। আশা করছি, অল্প কিছুদিনের মধ্যে পানি কমে আসবে।

গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম সাংবাদিকদের বলেছেন, দেশে বর্তমানে বন্যাপ্লাবিত জেলার সংখ্যা ১১টি। ১২ লাখ ৭ হাজার ৪২৯টি পরিবার পানিবন্দি। বন্যায় এখন পর্যন্ত প্রাণ গেছে ২৭ জনের, আর ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ৫৬ লাখ ১৯ হাজার ৩৭৫ জন। এসময় বিভিন্ন বাহিনীর ও সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

ত্রাণ উপদেষ্টা বলেন, বন্যাক্রান্ত জেলার মধ্যে রয়েছে ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজার। এসব জেলার ৭৪টি উপজেলা বন্যাপ্লাবিত। ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়ন ও পৌরসভার সংখ্যা ৫৪১টি। বন্যায় এ পর্যন্ত যে ২৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে কুমিল্লায় ১০ জন, ফেনীতে একজন, চট্টগ্রামে ৫ জন, খাগড়াছড়িতে একজন, নোয়াখালীতে ৫ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একজন, লক্ষ্মীপুরে একজন ও কক্সবাজারে ৩ জন মারা গেছে। এছাড়া মৌলভীবাজারে ২ জন নিখোঁজ আছেন।

তিনি বলেন, পানিবন্দি বা ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের জন্য মোট ৩ হাজার ৮৮৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে মোট ৫ লাখ ৯ হাজার ৭২৮ জন লোক এবং ৩৪ হাজার ৪২১টি গবাদিপশুকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। কীভাবে বন্যা হলো, এটা রাজনৈতিক বন্যা পরিস্থিতি কি না তা খতিয়ে দেখতে হবে। এ বিষয়ে তিনি সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

ফারুক-ই-আজম বলেন, ১১ জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসাসেবা দিতে মোট ৬২০টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে। সব বাহিনীর সহায়তায় ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত আছে। সরকার সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছে। সব জেলা ও উপজেলায় পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী মজুত রয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কেএম আলী রেজা বলেন, বন্যাদুর্গত এলাকার কয়েক জায়গায় ফিল্ড হাসপাতাল প্রস্তুত আছে। সেনাবাহিনী ও জেলার সিভিল সার্জন কার্যালয়ের চিকিৎসকরা সেখানে সেবা দিচ্ছেন। পাশাপাশি স্থানীয় ক্লিনিক, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্যার্তদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকরা নির্দেশনা দিয়েছেন। ব্রিফিংয়ে আরো জানানো হয়, বন্যার্তদের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ছয় দিনে নগদ কালেকশন হয়েছে ৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকার বেশি। এর মধ্যে ৬০ লাখ টাকার বেশি এসেছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। এছাড়া দেশের বন্যা উপদ্রুত এলাকায় সরকারি-বেসরকারিসহ সব পর্যায় থেকে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত আছে। বন্যা আক্রান্ত জেলাগুলোর জেলা প্রশাসককে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, মেডিকেল টিম ও স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে সমন্বয় করে একসঙ্গে কাজ করার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

বন্যা আক্রান্ত জেলাগুলোতে মোবাইল ও টেলিফোন যোগাযোগ পুনঃস্থাপন করা হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে কন্ট্রোল রুম সার্বক্ষণিক খোলা রয়েছে। তথ্য ও সহযোগিতার জন্য ০২৫৫১০১১১৫ নম্বর চালু রয়েছে। এছাড়া সাম্প্রতিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য-সহায়তা দিতে চাইলে আগ্রহী ব্যক্তিরা প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলের অ্যাকাউন্টে অর্থ সহায়তা পাঠাতে পারেন। হিসাবের নাম: ‘প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল’, ব্যাংক: সোনালী ব্যাংক করপোরেট শাখা, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, হিসাব নম্বর: ০১০৭৩৩৩০০৪০৯৩।

এছাড়াও যারা ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হয়ে প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে সহায়তা (চেক/পে-অর্ডার/ব্যাংক ড্রাফটের মাধ্যমে) দিতে চান, প্রধান উপদেষ্টার পক্ষে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সরকারি ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন বিকাল ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টার কার্যালয়ে এই সহায়তা গ্রহণ করবেন।

যারা ত্রাণ তহবিলে সহায়তা (চেক/পে-অর্ডার/ব্যাংক ড্রাফটের মাধ্যমে) দিতে ইচ্ছুক তাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব অঞ্জন চন্দ্র পাল (মোবাইল-০১৭১৮-০৬৬৭২৫) বা সিনিয়র সহকারী সচিব শরিফুল ইসলাম (মোবাইল-০১৮১৯২৮১২০৮)-এর সঙ্গে যোগাযোগ করার অনুরোধ করা যাচ্ছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত