ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

এগারো জেলায় বন্যায় মৃত্যু ৩১

কোথাও স্বস্তি, কোথাও অস্বস্তি

* ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় বন্যার্তরা * বন্যায় শ্বাসকষ্টের রোগী বাড়ছে
কোথাও স্বস্তি, কোথাও অস্বস্তি

ভারতের উজানের ঢল ও বৃষ্টিপাতে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ১১ জেলার কোথাও বন্যার উন্নতি, কোথাও অবনতি। তবে যেসব এলাকার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে, সেসব এলাকার বাসিন্দারা আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে নিজ বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছেন। ঘরে-বাইরে সবখানে পানি থাকায় মাচার ওপর বিকল্প চুলা তৈরি করে রান্না করছেন। আবার যেসব এলাকায় বন্যার পরিস্থিতি অবনতি ঘটেছে, সেসব এলাকার বাসিন্দারা আতঙ্কে রয়েছেন।

বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকটে বানভাসি মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বন্যায় ফসলের ও সড়কের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা ও লক্ষ্মীপুর জেলায় বেশিরভাগ এলাকার বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। বন্যার পানির কারণে নিকটস্থ আশ্রয়কেন্দ্র, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে অবস্থান নেয়ায় ঠাসাঠাসি থাকতে হচ্ছে মানুষকে। পানি কমায় অনেক পরিবার আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে নিজ বাড়িতে ফিরছেন।

এদিকে এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বন্যার পানিতে নিমজ্জিত থাকায় প্রত্যন্ত এলাকায় এখনো ঠিকমতো ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন। অথচ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ত্রাণবাহী অনেক গাড়ি প্রতিদিনই বন্যাকবলিত এলাকায় ঢুকছে। মূলত প্রশাসনের সঙ্গে ব্যক্তি উদ্যোগে পরিচালিত ত্রাণ কার্যক্রমের সমন্বয় না থাকায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুটে উঠছে ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন। দুর্গম যেসব এলাকায় এত দিন যাওয়া সম্ভব হয়নি সরকারি-বেসরকারি ত্রাণকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবীদের, এখন সেসব এলাকায় পৌঁছাচ্ছেন তারা। তবে ত্রাণের জন্য হাহাকার কাটেনি। বন্যায় ক্ষতির এমন চেহারা প্রায় সবখানে। পুকুরসহ মাছের ঘেরগুলো ভেসে গেছে, নষ্ট হয়েছে কৃষকের মাঠের ফসল, ব্যবসায়ীদের দোকানে পানি ঢুকে নষ্ট হয়েছে সব মালপত্র, ঘরের কোনো আসবাবপত্র আর ব্যবহারযোগ্য নেই।

গতকাল বুধবার সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কেএম আলী রেজা বলেছেন, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে। দেশের সব নদ-নদীর পানি নেমে যাচ্ছে এবং ভারি বৃষ্টিপাতের কোনো পূর্বাভাস নেই। এছাড়া সাম্প্রতিক বন্যায় ১২ লাখের বেশি পরিবার এবং ১১টি জেলার মোট ৫৮ লাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় এখন পর্যন্ত ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতদের মধ্যে কুমিল্লার ১২ জন, ফেনীর দুজন, চট্টগ্রামে ৫ জন, খাগড়াছড়ির একজন, নোয়াখালীর ৬ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একজন, লক্ষ্মীপুরে একজন ও কক্সবাজারের তিনজন রয়েছেন। এছাড়া মৌলভীবাজারে নিখোঁজ রয়েছেন দুজন। বন্যায় বাস্তুচ্যুতদের সহায়তার জন্য সরকার ৪ হাজার ৩টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছে এবং ৫ লাখ ৪০ হাজার ৫১০ জন মানুষ এবং ৩৯ হাজার ৫৩১টি গবাদিপশুকে আশ্রয় দিয়েছে। এছাড়া দুর্গতদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোতে মোট ৬১৯টি মেডিকেল টিম মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া দেশের সব জেলায় পর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী মজুদ রয়েছে এবং বন্যা উপদ্রুত এলাকায় সরকারি বেসরকারিসহ সব পর্যায় থেকে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত আছে বলে জানিয়েছে ত্রাণ মন্ত্রণালয়। এছাড়া বন্যাকবলিত জেলাগুলোর জেলা প্রশাসককে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, সিভিল ডিফেন্স, মেডিকেল টিম ও স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

নোয়াখালী : নোয়াখালীর সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির মধ্যে জেলা শহর মাইজদীসহ সদর উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। জেলার অনেক এলাকায় ঠিকমতো ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না বলে জানান বাসিন্দারা। তবে নোয়াখালী জেলার সেনবাগ, কবিরহাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। বেগমগঞ্জ, সোনাইমুড়ী ও চাটখিল উপজেলার বন্যা কার্যত অপরিবর্তিত রয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার সকালে বৃষ্টিপাতের ফলে কিছু এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে বলে জানান পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা। জেলা আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, গতকাল সকালে জেলা শহর মাইজদীতে ৬৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, যা আগের ২৪ ঘণ্টার তুলনায় ৩৮ মিলিমিটার কম। আগের বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ১০২ মিলিমিটার।

আগামী ২৪ ঘণ্টায়ও জেলায় বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে।

সেনবাগ উপজেলার কেশারপাড় ইউনিয়নের লুদুয়া গ্রামের বাসিন্দা সেনাসদস্য মো. মামুন বলেন, দুই দিন ধরে উপজেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করছেন ত্রাণের জন্য। তার এলাকার বেশিরভাগ মানুষ কোনো ত্রাণ পায়নি। ব্যক্তিগতভাবে কিছু ত্রাণের ব্যবস্থা করেছেন। এ অবস্থায় ত্রাণের জন্য বন্যায় পানিবন্দি মানুষের মধ্যে হাহাকার চলছে।

চাটখিল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, চাটখিলে বন্যার পানি এখনো কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। উপজেলার নয়টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা পুরোপুরি প্লাবিত হয়ে আছে। এখানকার প্রায় দুই লাখ মানুষ বন্যাকবলিত। এর মধ্যে প্রায় ১২ হাজার মানুষ বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। সরকারিভাবে তিনি এ পর্যন্ত ৪৫ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পেয়েছেন। এছাড়া যা আসছে সবই ব্যক্তি উদ্যোগের ত্রাণ। কিন্তু চাহিদার তুলনায় ত্রাণ একেবারেই অপ্রতুল।

কুমিল্লা: কুমিল্লার গোমতীর বিপৎসীমার ২৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পানি। নদীর পানি অব্যাহত প্রবেশ করছে বুড়িচং উপজেলায়। এতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়ায় বন্যার পানি। কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী খান মো. ওয়ালিউজ্জামান বলেন, গত ২২ আগস্ট বুড়িচং এলাকায় গোমতীর বাঁধ ভাঙার ফলে শুক্রবার সকাল থেকে নদীতে পানি কমতে শুরু করে। বর্তমানে বিপৎসীমার ২৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

এর আগে ১৩৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে গোমতী পানি। উজানে বৃষ্টি না হলে অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত বলতে পারেন। বুড়বুড়িয়া এলাকায় ধসেপড়া গোমতী বাঁধ ক্রমেই প্রশস্ত হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ২০০ মিটার প্রশস্ত হয়ে নদী থেকে পানি বের হয়ে বুড়িচং এবং ব্রাহ্মণপাড়ায় পানির পরিমাণ বাড়ছে। গোমতীর পানি জমিন লেভেল না হওয়া পর্যন্ত দুই উপজেলায় পানি আরো বাড়তে পারে।

কুমিল্লা, নোয়াখালী ও ফেনীর বন্যাদুর্গত এলাকায় শ্বাসকষ্টের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বেশিরভাগ রোগী শ্বাস কাশি, গলাব্যথা, বুকে ব্যথা, হাঁচিসহ ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। কুমিল্লার বুড়িচংয়ের বন্যাদুর্গত রাজাপুর ইউনিয়নের দুর্গম আশ্রয়কেন্দ্র লড়িবাগ প্রাইমারি স্কুলে চিকিৎসা সেবাদান শেষে এসব তথ্য জানান ঢাকা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক তানভীর আহাদ জয় ও ডা. সাবরিনা মনসুর।

চট্টগ্রাম : চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে ভয়াবহ বন্যায় উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের পানি এখনও পুরোপুরি নামেনি। বন্যায় উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভার অন্তত দুই লাখ মানুষ কার্যত পানিবন্দি হয়ে পড়েছিল। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অসংখ্য কাঁচা ও মাটির ঘর। দুই দিন ধরে অধিকাংশ ঘর থেকে পানি নামলেও উঠানে ও গ্রামীণ সড়কে পানি থাকায় স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরতে পারছে না এখানকার মানুষ। চট্টগ্রাম উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের প্রায় ১৬৫টি গ্রাম বন্যার পানি প্লাবিত। প্রথম দিকে উপজেলার ১৮২টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ গবাদিপশু নিয়ে আশ্রয় নেয়।

ওই দিন উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নের পশ্চিম জোয়ার ও অলিনগর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এখানে বাড়ি-ঘর থেকে বানের পানি নেমে গেছে। এখানকার মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফেরার জন্য লড়াই করছেন। তবে পশ্চিম জোয়ার গ্রামের অধিকাংশ কাঁচা ও মাটির ঘর মাটিতে মিশে গেছে। এখানে ভেসে গেছে শত শত গবাদিপশু। গ্রামের বাসিন্দা জহির উদ্দিন জানান, বন্যার শুরুতেই তলিয়ে যায় করেরহাট ইউনিয়নের পশ্চিম জোয়ার গ্রাম। এ গ্রাম ফেনী নদীর পাশে হওয়ার দরুন পানি তীব্রতাও বেশি ছিল। এখানে দরিদ্র পরিবারগুলোর সহায়-সম্বল বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।

মীরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা প্রশাসক মাহফুজা জেরিন বলেন, বন্যা পরিস্থিতি আগামী দুয়েক দিনের মধ্যে স্বাভাবিক হবে বলে আমরা আশা করছি।

এখন আমরা জনস্বাস্থ্য ও পুনর্বাসন নিয়ে পরিকল্পনা করছি। বন্যাকবলিত মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে আমরা ব্যাপক কাজ করছি। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সহায়তা নিয়ে গ্রামে গ্রামে মেডিকেল টিম গঠন করে শিশু-নারী ও বৃদ্ধদের চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত