ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সহসা সরছে না বন্যার পানি

বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, মৃত্যু ৫২

* ৭ হাজার ৭২২ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত * ফসল, মৎস্য ও গবাদি খাত নিয়ে হিমশিম * সাপের আতঙ্কের সঙ্গে বিশুদ্ধ পানির সংকট
বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, মৃত্যু ৫২

উজানের ঢল ও বৃষ্টিপাতে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের এগারো জেলায় দ্রুতগতিতে পানি প্রবেশ করলেও ধীর গতিতে নামছে বন্যার পানি। এতে বন্যাকবলিত জেলাগুলোয় ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। একইসঙ্গে বন্যার পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে উঠছে ক্ষতচিহ্ন। ইতোমধ্যে চলমান বন্যায় প্রাথমিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৭ হাজার ৭২২ কিলোমিটার সড়ক। এ পর্যন্ত স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ৫১ কিলোমিটার সড়ক মেরামত করেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানায়।

হবিগঞ্জ, খাগড়াছড়ি, ফেনী, চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় উন্নতি হলেও বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে কুমিল্লা, নোয়াখালী, সুনামগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর ও মৌলভীবাজার জেলায়। নতুন করে কোনো জেলা বন্যায় প্লাবিত হয়নি।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বন্যাদুর্গত এলাকায় নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনে থাকা সব দপ্তর, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান। আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা, সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ নিরবচ্ছিন্ন রাখা এবং ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক দ্রুত মেরামতের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। এলজিইডি থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় প্রাথমিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৭ হাজার ৭২২ কিলোমিটার রাস্তা এবং এক হাজার ১০১টি ব্রিজ-কালভার্ট। এ পর্যন্ত এলজিইডি মেরামত করেছে ৫১ কিলোমিটার রাস্তা এবং ৯৬টি ব্রিজ ও কালভার্ট। সড়কের পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ত্রাণের জন্য হাহাকার কাটেনি। বন্যায় ক্ষতির এমন চেহারা প্রায় সবখানে। পুকুরসহ মাছের ঘেরগুলো ভেসে গেছে, নষ্ট হয়েছে কৃষকের মাঠের ফসল, ব্যবসায়ীদের দোকানে পানি ঢুকে নষ্ট হয়েছে সব মালপত্র, ঘরের কোনো আসবাবপত্র আর ব্যবহারযোগ্য নেই।

ফেনীতে বন্যায় ভেসে গেছে সড়ক, ঘরবাড়ি, গবাদিপশু। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে মৎস্য ও কৃষি খাতে। এ দুটি খাতে শুধু ফেনী জেলায় অন্তত ৫০০ কোটি টাকার ক্ষতির আশঙ্কা করছে সংশ্লিষ্ট বিভাগ। সরেজমিনে দেখা গেছে, পানি নেমে যাওয়ার পর ক্ষেতে মাচা থাকলেও নেই সবুজ গাছ। পানির নিচ থেকে ভেসে উঠছে হলুদ, আদা, আউশ, আমন ও শীতকালীন আগাম বিভিন্ন সবজির ক্ষেত। দেড় মাসের ব্যবধানে তৃতীয় দফায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় জেলার ছয় উপজেলায় শুধুমাত্র কৃষিতে ক্ষতি হয়েছে ৪৫১ কোটি ২০ লাখ টাকার বেশি। এতে প্রায় দুই লাখের বেশি কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এদিকে বন্যায় জেলার অধিকাংশ পুকুর ও ঘেরের মাছ পানিতে ভেসে গেছে। বন্যায় মৎস্য খাতে রেণু, পোনা, বড় মাছ ও পুকুরের অবকাঠামোগত ক্ষতি সাধিত হয়েছে। ফেনী জেলার মৎস্য বিভাগ সূত্র জানায়, কয়েকদিনে জেলার ছয় উপজেলায় বন্যায় মাছ চাষিদের ২৮ কোটি ৯ লাখ ২০ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এ খাত সংশ্লিষ্ট ২০ হাজারের বেশি মানুষ। বন্যার পানিতে ভেসে গেছে একক ও যৌথ মালিকা ১৮ হাজার ৭৬০টি পুকুর-দীঘি। এসব পুকুর থেকে ২২ কোটি ৬৪ লাখ টাকার বড় মাছ এবং ১৯৭ লাখ টাকার মাছের পোনা ভেসে গেছে। এছাড়া জেলায় খামারিদের ৫৪ লাখ টাকার অবকাঠামো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ফেনী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম জানান, মৎস্য খাতে ২৮ কোটি ৯ লাখ ২০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে আরও সময় লাগবে। ফেনী জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বন্যায় জেলার ৩০ হাজার ৩৫২ হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যা মোট ফসলি জমির ৭৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। তারমধ্যে এক হাজার ৮৬৫ হেক্টর আমন বীজতলা, ২৬ হাজার হেক্টর আমন, এক হাজার ৮৫৪ হেক্টর আউশ, আবাদ করা ৫২৫ হেক্টর শরৎকালীন সবজির পুরো অংশ, ৬৯ হেক্টর ফল বাগান, ৭ হেক্টর আদা, ১৬ হেক্টর হলুদ এবং ১৬ হেক্টর আখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সাপের আতঙ্ক: ফেনী জেনারেল হাসপাতালে একদিনে ২৪ জন সাপে কাটা রোগী ভর্তি হয়েছেন। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন ৭১ জন। বাড়ছে শ্বাসকষ্ট জনিত রোগীর সংখ্যাও। গতকাল বৃহস্পতিবার হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মোবারক হোসেন দুলাল এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

বিশুদ্ধ পানির সংকট: বিশুদ্ধ পানি সংকট তৈরি হয়েছে। বন্যার পানিতে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে মানুষকে। এতে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। সরকারি-বেসরকারিভাবে পাওয়া ত্রাণের মাধ্যমে খাদ্যসংকট কিছুটা দূর হলেও বিশুদ্ধ পানির সংকটে ভুগছে বন্যা কবলিত এলাকার মানুষ। লক্ষ্মীপুর সদরের পশ্চিম জামিরতলি গ্রামের বাসিন্দা আবদুর রহিম ও জয়নাল আবেদিন জানান, পুরো এলাকা ৩-৪ ফুট পানিতে নিমজ্জিত। প্রত্যেকটি টিউবওয়েল এখন পানির নিচে। টিউবওয়েল চাপ দিলেই ময়লা পানি উঠে আসে। বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। অনেকেই বাজার থেকে পানি কিনে খাচ্ছেন। আবার ত্রাণের সঙ্গে দেওয়া পানিও অপ্রতুল। বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দিয়েও আশপাশের টিউবওয়েলের পানি পানে ইচ্ছা করছে না। লক্ষ্মীপুরের মতোই অন্যান্য জেলাগুলোয় বিশুদ্ধ পানির সংকট রয়েছে।

বন্যায় এখন পর্যন্ত ৫২ জনের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে ফেনীতে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া কুমিল্লায় ১৪ জন, চট্টগ্রামে ৬ জন, নোয়াখালীতে ৮ জন, কক্সবাজারে ৩ জন এবং খাগড়াছড়ি, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, লক্ষীপুর ও মৌলভী বাজারে ১ জন করে মারা গেছে। এর বাইরে একজন নিখোঁজ আছেন মৌলভী বাজারে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী রেজা বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে বন্যা পরিস্থিতির সর্বশেষ তথ্যের বিষয়ে বলেন, ১১ জেলায় ১০ লাখ ৭২ হাজার ৫৭৯টি পরিবার এখনো পানিবন্দি; ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৫৪ লাখ ৮০ হাজার ৪৬৩ জন। যারা মারা গেছেন, তাদের মধ্যে ৩৯ জন পুরুষ; ৭ জন শিশু এবং ৬ জন নারী।

?আলী রেজা বলেন, পানিবন্দি-ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য দুর্গত এলাকাগুলো ৪ হাজার ৪০৩টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ৫ লাখ ২ হাজার ৫০১ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। আর ৩৬ হাজার ৪৪৮টি গবাদি পশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা সেবা দিতে এসব এলাকায় ৫৯৫টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। এছাড়া বন্যা দুর্গত এলাকার জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী ‘মজুদ রয়েছে’ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বন্যা উপদ্রুত এলাকায় সরকারি-বেসরকারিসহ সব পর্যায় থেকে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত আছে।’

সংবাদ সম্মেলনে আলী রেজা বলেছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে সংগ্রহ করা ১ লাখ ৪ হাজার ১০০ প্যাকেট শুকনা খাবার, কাপড় ও পানি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর (ডিডিএম) এর মাধ্যমে বন্যা কবলিত এলাকায় পাঠানো হয়েছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর (ডিডিএম) এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের মধ্যে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে।

আলী রেজা বলেন, বন্যা দুর্গত জেলাগুলোর জেলা প্রশাসকদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, মেডিকেল টিম ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া চিকিৎসা সেবা দিতে ফিল্ড হাসপাতাল প্রস্তুত করা হয়েছে। এর পাশাপাশি স্থানীয় ক্লিনিক, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোয় বন্যার্তদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদেরও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, বন্যা দুর্গত জেলাগুলোতে মোবাইল ও টেলিফোন যোগাযোগ পুনঃস্থাপন করা হয়েছে। বন্যা পরবর্তী পানি বাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব রোধে সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে কন্ট্রোল রুম সার্বক্ষণিক খোলা রয়েছে। যে কোনো তথ্য ও সহযোগিতার জন্য ০২৫৫১০১১১৫ নম্বরে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করেছেন অতিরিক্ত সচিব আলী রেজা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত