সব নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে

স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে মানুষ

* বন্যায় মৃতের সংখ্যা ৫৪ * লোকসানে খামারিরা * ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র সামনে আসছে

প্রকাশ : ৩১ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

উজানের ঢল ও বৃষ্টিপাত কমায় দেশের সব নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদীর পানি কমছে। এছাড়া উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানিও কমেছে। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে বন্যাকবলিত এলাকার ক্ষতচিহ্ন সড়ক, কৃষি ফসল, পুকুরের মাছ, মুরগি ও গরুর খামারিতে প্রকৃত লোকসান সামনে আসতে শুরু করেছে। বিভিন্ন খাতে ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয়ে সংশ্লিষ্টরা কাজ চালাচ্ছেন। এরইমধ্যে বন্যাকবলিত এলাকার খণ্ড খণ্ড ক্ষতির চিত্র সামনে আসছে। আগামী দুই সপ্তাহ বন্যার পরিস্থিতি আরো উন্নতির দিকে গেলে সব খাতের ক্ষতির প্রকৃত জানা যাবে। তবে কুমিল্লা ও চাঁদপুরের কয়েকটি উপজেলায় এখনও মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছেন।

চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলায় বন্যার পানি কমায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরছেন মানুষ। বন্যার পানি নামলেও ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে রাস্তাঘাট। অসংখ্য কাঁচা-ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। খামারের গরু, হাঁস-মুরগি ভেসে গেছে বন্যার পানিতে। পুকুরে মাছ নেই, ক্ষেতে নেই ফসল। এখনও সড়কের পাশে দোকানপাট খুলতে শুরু করেছে।

ফেনী জেলার বাসিন্দা হেলু কাজী বলেন, বন্যার পানির কারণে টানা সাত দিন আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলাম। সেখানে বিভিন্ন লোকজন ভালো খাবারদাবার দিয়েছে। এখন বাড়ি ফিরে দেখি বসতঘর-গোয়ালঘর কিছুই নেই। সব বন্যা কেড়ে নিয়েছে।

গতকাল শুক্রবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের বন্যা পরিস্থিতি সম্পর্কিত হালনাগাদ তথ্যাদির প্রতিবেদন বলা হয়েছে, বন্যায় মৃত লোকসংখ্যা ৫৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৪১ জন, নারী ৬ জন ও শিশুর সংখ্যা ৭। বন্যায় কুমিল্লা?য় ১৪, ফেনীতে ১৯, চট্টগ্রামে ৬, খাগড়াছড়িতে এক, নোয়াখালীতে ৮, ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় এক, লক্ষীপুরে এক, কক্সবাজার ৩ ও মৌলভীবাজারে একজন মারা গেছেন। পানিতে ডুবে, সাপের কামড়ে ও বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তারা মারা যান। মৌলভীবাজারে এখনো একজন নিখোঁজ রয়েছেন বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।

সিলেট, হবিগঞ্জ ও চট্টগ্রাম জেলা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বন্যা পরিস্থিতির সার্বিক উন্নতি হয়েছে জানিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় প্রতিবেদনে জানায়, ৬৪ উপজেলা বন্যা প্লাবিত এবং ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়ন-পৌরসভা ৪৮৬টি। ১১ জেলায় মোট ১০ লাখ ৯ হাজার ৫২২ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ৫৪ লাখ ৬৪ হাজার ১৬৭ জন। ৩ হাজার ২৬৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে এখনো ৪ লাখ ৬৯ হাজার ৬৮৭ জন মানুষ এবং ৩৮ হাজার ১৯২টি গবাদি পশুকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। ১১ জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য মোট ৫৬৭টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে।

ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে আরো জানানো হয়, সশস্ত্র বাহিনী বন্যাদুর্গত এলাকায় ১ লাখ ৯৪ হাজার ২৮৫ প্যাকেট ত্রাণ, ১৯ হাজার ২৬০ প্যাকেট রান্না করা খাবার বিতরণ করেছে। মোট ৪২ হাজার ৭৬৬ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে এবং ১৮ হাজার ৩৮৯ জনকে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া হেলিকপ্টারের মাধ্যমে ১৫৩ জনকে উদ্ধার করে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীর পরিচালিত মোট ২৪টি ক্যাম্প এবং ১৮টি মেডিকেল টিম বন্যা উপদ্রুত এলাকায় চিকিৎসাসেবা প্রদান করছে।

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলায় এবারের ভয়াবহ বন্যায় ৪৭৬ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই এলাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্টের। ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, বন্যায় মাছের প্রজেক্ট, খেতের ফসল, গৃহপালিত প্রাণী, রাস্তা-ঘাট ও ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। টাকার অংকে এ ক্ষতির পরিমাণ ৪৭৬ কোটি টাকার সমপরিমাণ।

চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলায় পোলট্রি শিল্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। নিঃস্ব হয়ে গেছেন অনেকে খামারি। টাকার অংকে প্রায় ১০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়ে বলে জানিয়েছে উপজেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। মিরসরাই উপজেলা পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, বন্যায় পোলট্রি শিল্পে অনেক ক্ষতি হয়েছে। অনেক খামারি পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত খামারগুলোতে আগামী ৩ মাস মুরগির বাচ্চা তোলা যাবে না। অনেকে বেকার হওয়ার আশঙ্কা করছি। মিরসরাই উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা জাকিরুল ফরিদ জানান, বন্যায় উপজেলার শতাধিক পোলট্রি খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে প্রায় ১০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এছাড়াও রাঙামাটিতে বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে দুই হাজার ১০০ হেক্টর জমির ফসল। যার আর্থিক ক্ষতি প্রায় ৪৪ কোটি টাকা।

গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের মনু নদীসহ অন্যান্য প্রধান নদীগুলোর পানি কমছে। আবহাওয়া সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন উজানে ভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। ফলে এ সময় এ অঞ্চলের সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, খোয়াই, ফেনী, মুহরি, গোমতী, তিতাস ইত্যাদি নদীর পানি কমতে পারে এবং বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে।

দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদীর পানিও কমতে শুরু করেছে। আবহাওয়া সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও সংলগ্ন উজানে ভারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস নেই। এ সময় এ অঞ্চলের সাঙ্গু, মাতামুহুরি, কর্ণফুলী, হালদা ও অন্যান্য প্রধান নদীর পানি কমতে পারে।