স্পষ্ট হচ্ছে বন্যার ক্ষত চিহ্ন

প্রকাশ : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশের ১১ জেলায় বন্যার পানি কমায় বেরিয়ে আসছে ধ্বংসের চিহ্ন। পানির স্রোতে বাঁধ ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে উধাও হয়ে গেছে বাড়িঘর। অনেক নিম্ন এলাকা থেকে পানি নামেনি, সেজন্য পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভাজকে অবস্থান নিয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে জায়গার সংকট থাকায় উঁচু স্থানে যত্রতত্রভাবে ছোট্ট ছাউনিটিতে গাদাগাদি করে বাস করছেন মানুষ। আবার যেসব এলাকার পানি নেমে গেছে, সেসব এলাকার মানুষ নিজ বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছেন।

সরজমিনে নোয়াখালী ও কুমিল্লার কিছু এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মাইলের পর মাইল রাস্তা নষ্ট হয়ে গেছে। হাঁটার পরিস্থিতি নেই অনেক রাস্তায়। কিছু এলাকায় ব্রিজ ভেঙে যাওয়ায় বাঁশের সাঁকো বানিয়ে কোনোভাবে হেঁটে যাতায়াতের ব্যবস্থা করে নিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে যোগাযোগব্যবস্থা চরম খারাপ থাকায় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানো সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক কষ্টে বেসরকারি সংস্থা ও শিক্ষার্থীরা ত্রাণ নিয়ে গেলে ঘিরে ধরছেন শত শত মানুষ। অনেক নিম্ন এলাকা থেকে পানি নামেনি। এতে এখনো অনেক পরিবারের ঘরে চুলা জ্বলছে না। বাইরে থেকে রান্না করা খাবার সংগ্রহ করে খেতে হচ্ছে তাদের। কিছু এলাকার মানুষ নিজ বাড়িতে ফিরতে শুরু করলেও খাদ্য এবং বিশুদ্ধ পানি সংকট কাটেনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনেকের বসতঘর পুরোটাই যেন ধ্বংসস্তূপ। বানভাসি পরিবারগুলো সব হারিয়ে পথে বসার উপক্রম। খাবারের পাশাপাশি পুনর্বাসনের চিন্তায় তাদের চোখে ঘুম নেই। কুমিল্লা এলাকার বাসিন্দা সবুজ মিয়া বলেন, জীবনে এমন বন্যা দেখিনি। এ বন্যায় সব শেষ করে দিয়েছে। হঠাৎ বন্যা হওয়ায় থাকার ঘর, পুকুরের মাছ, জমির ধান কিছুই রক্ষা করতে পারিনি।

নোয়াখালী এলাকার গৃহবধূ লাভলী আক্তার বলেন, বন্যার পানিতে সব ভেসে গেছে। প্রায় ১০ দিন চুলা জ্বলছে না। রান্নাঘরে পানি। প্রথম পাঁচদিন তো ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলাম। দুদিন আগে বাড়ি এসেছি। কিন্তু এখনো চুলায় আগুন দিতে পারিনি। আমাদের একমাত্র ভরসা শুকনা খাবার। সব হারানোর এমন গল্প একটা দুটো নয় শত শত। ঘর, আসবাব, কাপড়চোপড় থেকে ব্যবসার পুঁজি সব হারিয়ে দিশাহারা মানুষগুলো। বানের পানি যতই কমছে, মানুষের বেঁচে থাকার সহায়-সম্বলগুলোর ক্ষত চিহ্ন যেন ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে।

এদিকে বন্যা-পরবর্তী স্থানীয়দের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কার্যক্রমে মাঠে কাজ করছে সেনাবাহিনী, উপজেলা প্রশাসন এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো।

বন্যাকবলিত এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, বন্যার পানি কমেছে, এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ভাঙা ঘর কোনো রকমে দাঁড় করানো আর তিন বেলা খাবার। সড়ক ভেঙে যাওয়ায় ত্রাণের গাড়ি বিভিন্ন এলাকায় ঢুকতে পারছে না। দরিদ্র মানুষ ত্রাণ পাচ্ছেন না। আবার যাদের ঘর ভেসে গেছে, তারা প্রান্তিক পর্যায়ের। তাদের নতুন করে মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরির মতো আর্থিক সামর্থ্য নেই। কারণ, তাদের বেশিরভাগই দিনমজুর, জেলে ও অল্পস্বল্প কৃষিকাজ করে তাদের সংসার চলে। আউশ ধান তো এবার আগেই ধ্বংস হয়েছে। আর আমনও শেষ হয়ে গেল।

দুর্যোগব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় গতকাল জানিয়েছে, চলমান বন্যায় ১১ জেলায় মোট ৫৯ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে পুরুষ ৪১ জন, নারী ছয়জন ও শিশু ১২ জন?। এদের মধ্যে কুমিল্লায় ১৪ জন, ফেনীতে ২৩, চট্টগ্রামে ছয়, খাগড়াছড়িতে এক, নোয়াখালীতে ৯, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একজন, লক্ষ্মীপুরে একজন, কক্সবাজারে তিনজন ও মৌলভীবাজারে একজন। এছাড়া মৌলভীবাজারে একজন নিখোঁজ রয়েছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। গত শুক্রবার মোট মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা ছিল ৫৪ জন। চট্টগ্রাম, হবিগঞ্জ, সিলেট, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজার জেলার বন্যা পরিস্থিতি এখন পুরোপুরি স্বাভাবিক। মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। এছাড়া কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে বলেও জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়। বর্তমানে মোট ৬ লাখ ৯৬ হাজার ৯৯৫টি পরিবার পানিবন্দি। ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ৫৪ লাখ ৫৭ হাজার ৭০২ জন। পানিবন্দি বা ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের আশ্রয় দিতে মোট ৩ হাজার ৯২৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।

আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মোট ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৩০৫ জন লোক এবং ৩৬ হাজার ১৩৯টি গবাদিপশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ১১ জেলায় ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসাসেবা দিতে মোট ৫১৯টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে বলেও প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। বন্যা উপদ্রুত এলাকায় সরকারি-বেসরকারিসহ সব পর্যায় থেকে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত আছে জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সংগ্রহ করা মোট ১ লাখ ৪০ হাজার ৯০০ প্যাকেট শুকনো খাবার, কাপড় ও পানি দুর্যোগব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মাধ্যমে বন্যাকবলিত এলাকায় পাঠানো হয়েছে। গতকাল শনিবার চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস সম্মেলন কক্ষে জেলার সাম্প্রতিক বন্যা পরিস্থিতি সংক্রান্ত মতবিনিময় সভা শেষে ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বীর প্রতীক বলেছেন, ‘বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সরকারের প্রথম কাজ হবে পুনর্বাসন করা। আমরা সে লক্ষ্যে কাজ করছি।’

বন্যার্তদের পুনর্বাসন প্রসঙ্গে উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বলেন, ‘বন্যা ও বন্যা-পরবর্তী পরিস্থিতি জানার জন্য মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে এ সভা আহ্বান করেছিলাম। তাদের কাছ থেকে বাস্তব চিত্র জানলাম। তারা এ সভায় স্ব স্ব অভিজ্ঞতা আমাদের কাছে শেয়ার করেছেন। এর আলোকে যে পুনর্বাসন কর্মসূচি হবে, তার একটা ধারণা পেলাম। যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করা হবে। এখনও ত্রাণ কার্যক্রম চলমান আছে। বন্যার পানি সম্পূর্ণভাবে নামার পর পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করব।’

তিনি আরো বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আরেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে জনস্বাস্থ্য। বন্যা-পরবর্তী সময়ে অনেকেই স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। তারা যাতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা পান সে জন্য সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা প্রশাসক মাহফুজা জেরিন বলেন, পানি কমে যাওয়ায় প্রায় সবাই আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে বাড়িতে উঠেছেন। তবে অনেক বাড়িঘর ভেঙে গেছে, স্যাঁতস্যাঁতের কারণে ঘরে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। আশা করছি, দুই একদিনের মধ্যে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে।