ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

দ্বিধা-দ্বন্দ্বে চিকিৎসকদের কর্মবিরতি

* হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের আশ্বাস স্বাস্থ্য উপদেষ্টার * চিকিৎসক সুরক্ষা আইন চান আন্দোলনকারী চিকিৎসকরা
দ্বিধা-দ্বন্দ্বে চিকিৎসকদের কর্মবিরতি

হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় রোগীর মৃত্যুর জের ধরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দায়িত্বরত চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনার প্রতিবাদে কর্মবিরতি ঘোষণা করেছিলেন চিকিৎসকরা। তবে হামলাকারীদের আগামী চব্বিশ ঘণ্টায় গ্রেপ্তার করার আশ্বাসে হাসপাতালে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা চালু রাখলেও সম্পূর্ণরূপে কর্মবিরতি স্থগিত করেননি আন্দোলনকারী চিকিৎসকরা। গতকাল দশ ঘণ্টা কর্মবিরতির পর ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে জরুরি সেবা চালু করেন চিকিৎসকরা।

এর আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সভাকক্ষে আন্দোলনকারী চিকিৎসক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমন্বয়ক এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের সঙ্গে ত্রিমুখী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠক থেকে বেরিয়ে গতকাল রোববার সন্ধ্যা ৬টার দিকে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম সাংবাদিকদের বলেন, চিকিৎসকদের দাবিদাওয়া যত দ্রুত সম্ভব পূরণ করা হবে। একইসঙ্গে চিকিৎসকদের ওপর যারা হামলা করেছে, তাদের আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার করা হবে। আর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জমান বলেন, চিকিৎসকরা জরুরি সেবাসহ কিছু সেবা চালু করেছেন। কিন্তু আন্দোলনকারী চিকিৎসকরা বলেছেন, জরুরি সেবা চালু করা হলেও দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তারা কর্মবিরতি অব্যাহত রাখবেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগের আবাসিক সার্জন আবদুল আহাদ বলেন, এখন দাবি পূরণ হলে এখনই তারা কাজে ফিরবেন। অবশ্য চিকিৎসকদের আরেকটি পক্ষ বলছেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আসামিদের গ্রেপ্তারের আশ্বাস দেয়া হয়েছে। তাই আজ (সোমবার) রাত আটটা পর্যন্ত কর্মসূচি স্থগিত থাকবে। তাদের পাল্টাপাল্টি ঘোষণার মধ্যেই দশ ঘণ্টা কর্মবিরতির পর রাত আটটার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ চালু করা হয়।

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস টেকনোলজির (বিইউবিটি) শিক্ষার্থী আহসানুল হক দীপ্তর অবহেলায় মৃত্যুর অভিযোগে গত শনিবার বিকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে চিকিৎসকদের মারধর করা হয়। এতে নিউরো সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক ইমরান, মাশরাফি ও জুবায়ের আহত হন। চিকিৎসকদের ওপর হামলার প্রতিবাদে কর্মবিরতি ঘোষণা করেন আন্দোলনকারী চিকিৎসকরা। পরে গতকাল ঢামেক সভাকক্ষে চিকিৎসকদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন সমন্বয়করা। এরপর সেখানে অংশ নেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম। এসময় উপস্থিত ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মো. সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, ঢাকা মেডিকেলের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামান, ঢামেক চিকিৎসকসহ অন্যরা। এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের তিন চিকিৎসককে মারধর ও ভাঙচুরের ঘটনায় শাহবাগ থানায় মামলা হয়েছে। মামলায় আসামি করা হয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিইউবিটির শিক্ষকসহ তিন শিক্ষার্থীকে। এছাড়া ৪০-৫০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। এজাহারভুক্ত আসামিরা হলেন- বিইউবিটির শিক্ষক শাহরিয়ার অর্ণব, শিক্ষার্থী পলজয়, সহাব তুর্জ ও সাইমি নাজ শয়ন। রোববার ঢামেক হাসপাতালের অফিস সহায়ক আমির হোসেন (৫৩) বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় এজাহার দায়ের করেছেন। শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) একেএম শাহাবুদ্দিন মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়েছে, গত শুক্রবার রাতে ঢামেকের ২০০নং ওয়ার্ডে ডা. কানিজ ফাতেমা ইসরাত জাহানের তত্ত্বাবধানে অজ্ঞাত একজন সড়ক দুর্ঘটনার রোগী ভর্তি হয়। পরদিন শনিবার সকাল ৭টায় ওই রোগী মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তীতে মরদেহের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত করার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। পরে শনিবার বিকাল ৪টায় হঠাৎ করে নিউরোসার্জারি বিভাগের ২০১নং ওয়ার্ডের ইমার্জেন্সি অপারেশন থিয়েটারের চিকিৎসক আল মাশরাফিকে ৩০-৪০ জন লোক ঘিরে ধরে এলোপাতাড়ি কিলঘুষি মারতে থাকেন। একপর্যায়ে তাকে মারতে মারতে চিকিৎসকের গায়ের এপ্রোনটি খুলে ফ্লোরে ফেলে হাসপাতালে থাকা বিভিন্ন জিনিসপত্র দিয়ে তাকে মারধর করতে থাকেন। বাদী আরো অভিযোগ করেন, সেই সময় চিকিৎসক মো. ইমরান হোসেনসহ আমি এগিয়ে যাই এবং চিকিৎসক ইমরান হোসেন স্যারকে কেন মারধর করা হচ্ছে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের কাছ থেকে শুনতে চাইলে, অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের থেকে বাঁচাতে গেলে সেই সময় তাদের মধ্য থেকে একজন বলে ওঠে এই সেই ডাক্তার যে গত শনিবার ডিউটিতে ছিলেন। তখন তারা আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে ডা. ইমরানকে কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই হত্যার উদ্দেশ্যে মারধর শুরু করেন এবং টেনে হিচঁড়ে মারতে মারতে গায়ের পোশাক ছিঁড়ে হাসপাতালের পরিচালক স্যারের অফিস রুমে নিয়ে যান এবং সেখানে সবাইকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকরা কর্মবিরতি পালন করায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা শত শত রোগী ও তাদের স্বজনদের ভোগান্তি পোহাতে হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া জানান, গতকাল সকাল ৮টার পর থেকে জরুরি বিভাগসহ সব বিভাগের কর্মবিরতিতে সমর্থন জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের মুখপাত্র নিউরোসার্জন ডা. আব্দুল আহাদ বলেন, ঢামেকে যত চিকিৎসক দায়িত্ব পালন করবেন তাদের প্রত্যেকের বিপরীতে তত নিরাপত্তাকর্মী না দিলে কাজে ফিরবেন না। আর আগামী সাত দিনের মধ্যে চিকিৎসক সুরক্ষা আইন না করলে রুটিন ওয়ার্কেও ফিরব না আমরা। আন্দোলনরত চিকিৎসকরা চার দফা দাবি তুলেছেন। দাবিগুলো হচ্ছে- ১. হাসপাতালের মতো জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানে যেসব ব্যক্তি বা কুচক্রী মহল এই ন্যক্কারজনক ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাদের চিহ্নিত করা। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাদের গ্রেপ্তার করা। দ্রুত বিচার আইনের মাধ্যমে তাদের শাস্তির আওতায় আনা। ২. নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিত করা। এ লক্ষ্যে অবিলম্বে দেশের সব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্য পুলিশের (আমর্ড ফোর্স) মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ৩. নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে হাসপাতালে রোগীর ভিজিটর (ভিজিটর কার্ডধারী) ছাড়া বহিরাগত কাউকে কোনোভাবেই ভেতরে প্রবেশ করতে না দেয়া। বিষয়টি স্বাস্থ্য পুলিশের মাধ্যমে নিশ্চিত করা। ৪. হাসপাতালে রোগীর সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো অবহেলা-অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হলে, তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ আকারে জানানো। এভাবে শাস্তি নিশ্চিত করা যেতে পারে, কিন্তু কোনোভাবেই আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া যাবে না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত