কালো টাকা সাদার বিধান বাতিল
প্রকাশ : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
স্বৈরশাসক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় সারাদেশে অপ্রদর্শিত আয় বা কালো টাকা সাদা করার সুযোগ পেয়েছিলেন অনেকেই। এতে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকরা সহজেই কালো টাকা সাদা করে অঢেল সম্পদের মালিক হোন। কিন্তু সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালালে গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার ২৫ দিনের মাথায় ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সেই বিধান বা সুবিধা বাতিল করল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। গতকাল সোমবার এনবিআর কালো টাকা সাদা করার বিধান বাতিলের প্রজ্ঞাপন (এসআরও) জারি করে।
এনবিআরের আদেশ অনুযায়ী, শেয়ার মার্কেট, নগদ অর্থ, ব্যাংকে থাকা অর্থ, ফিন্যান্সিয়াল স্কিম অ্যান্ড ইন্সট্রুমেন্টসহ সব ধরনের আমানতের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা বৈধ করার সুবিধা বাতিল হয়ে গেল। এসব ক্ষেত্রে কালো টাকা সাদা করতে হলে এখন প্রযোজ্য কর, যা সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ সেটি দিতে হবে এবং ওই প্রদেয় করের ওপর ১০ শতাংশ জরিমানা দিতে হবে। তবে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুবিধা বাতিল হলেও ফ্ল্যাট, বাড়ি ও জমির কেনার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিয়ে টাকা সাদা করার বিদ্যমান সুবিধা বাতিল করা হয়নি।
গত বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সভা হয়। ওই সভায় অপ্রদর্শিত অর্থ হিসেবে বিবেচিত কালো টাকা বৈধ বা সাদা করার সুযোগ বাতিলের পক্ষে সিদ্ধান্ত হয়। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভা শেষে এই তথ্য জানান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে কালো টাকা সাদা করার যে বিধি ও রীতি বন্ধ করে দেয়া। এটা (কালো টাকা সাদা করার সুযোগ) থেকে সরকার যেটুকু টাকা আনতে পারে, সেটা খুব বেশি নয়। তবে মূল্যবোধ অবক্ষয় হয়।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে বিনাপ্রশ্নে অপ্রদর্শিত অর্থ, নগদ টাকা এবং শেয়ারসহ যে কোনো বিনিয়োগ নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিয়ে ঢালাওভাবে সাদা করার সুযোগ ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব দেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। অর্থনীতিবিদসহ বিভিন্ন মহলের সমালোচনার পরও বাজেটে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে তা বৈধ করার প্রস্তাব পাস করে সংসদ।
কালো টাকা সাদা করার বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এই সুযোগ দেয়াটা সংবিধানের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক ছিল। আমাদের সংবিধান এটা সমর্থন করে না। আবার ফৌজদারি আইনে যে কাজ করা অপরাধ, সেটা আপনি বিনা শর্তে ক্ষমা করে দিতে পারেন না। অবৈধ টাকা উপার্জন তো অপরাধ। তাহলে যিনি এই অপরাধ করেছেন তাকে বিচার ছাড়াই ক্ষমা করে দিচ্ছেন, এটা কোনোভাবেই ঠিক না।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের প্রায় সবকটি সরকারই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু, তেমন উল্লেখযোগ্যভাবে সাড়া না পাওয়ায় এসব উদ্যোগের বেশিরভাগই ব্যর্থ হয়। তবে কালো টাকা সাদা করার উদ্যোগকে বৈষম্যমূলক ও অযৌক্তিক বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
মূলত জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ বা অর্থ সাদা করার পরও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে কোনো বাধা না থাকার প্রভাব পড়ে কালো টাকা সাদা করায়। সর্বশেষ ২০২৩-২৪, ২০২২-২৩ অর্থবছরে কেউ কালো টাকা সাদা করেনি। তবে এর আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে কালো টাকা সাদা করেন ২ হাজার ৩১১ জন। অর্থের পরিমাণে তা ১ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা।
কালো টাকার ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে নানাভাবেই কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হয়। মূলত কালো টাকাকে অর্থনীতির মূল ধারায় আনতে এই সুযোগ দেয়া হয়। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা সাদা করা হয়েছে। সেখান থেকে তৎকালীন সময়ে সরকার মাত্র ১৯ লাখ টাকা আয়কর পায়। পরে এই সুবিধা বহাল থাকায় প্রতিবছরই কালো টাকা সাদা করার অঙ্ক বাড়তে থাকে। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ৫০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা সাদা করা হয়, সরকার আয়কর পায় ৮১ লাখ টাকা।
১৯৮১ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ৪৫ কোটি টাকা সাদা হয়, সরকার আয়কর পায় ৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ১৫০ কোটি টাকা সাদা করা হয়, আয়কর আদায় হয় ১৫ কোটি টাকা। এরপর ধারাবাহিকভাবে কালো টাকার অঙ্ক বাড়তে থাকে। ১৯৯৭ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত এক লাফে ৯৫০ কোটি টাকা সাদা করা হয়, আয়কর আদায় হয় ১৪১ কোটি টাকা। পরের ৭ বছর অর্থাৎ ২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ৮২৭ কোটি টাকা, ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা, ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা এবং ২০১৩ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ১১ হাজার ১০৭ কোটি টাকা মূল ধারার অর্থনীতিতে প্রবেশ করে। এ থেকে সরকার রাজস্ব পায় যথাক্রমে ১০২ কোটি, ৯১১ কোটি, ২৩০ কোটি ও ১ হাজার ৭৩ কোটি টাকা।