ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

হাসিনার পতনের একমাস

হাসিনার পতনের একমাস

জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে গণতন্ত্রের লেবাস লাগিয়ে একতরফা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠ হোন স্বৈরশাসক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর তার বিরুদ্ধে যারাই প্রতিবাদ করেছেন- তাদের জেল, জুলুম ও গুম করা হয়েছে। শেখ হাসিনার হাজারো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ও মিথ্যা কথার ফুলঝুঁড়িতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেন দেশের মানুষ। অথচ তার পাশে থাকা সুবিধাভোগীরা কখনই তার এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ও মিথ্যা কথার বিরুদ্ধে বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ করেননি। উল্টো স্বৈরশাসকের প্রশংসায় বিভোর ছিলেন সুবিধাভোগীরা। তারা বলেছিলেন- বাংলাদেশ চালানোর জন্য শেখ হাসিনার বিকল্প কেউ নেই। দেশকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে শেখ হাসিনার বিকল্প শেখ হাসিনাই। কিন্তু আজ সেই স্বৈরশাসকের পতনের একমাস পূর্ণ হলো। শেখ হাসিনা ছাড়াই এখন দেশ চলছে। সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা এবং পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়। তবে শেষমেষ আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে পালিয়ে যান ভারতে। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে বিপাকে পড়েছে ভারত। কারণ এরই মধ্যে শেখ হাসিনার কূটনৈতিক লাল পাসপোর্ট বাতিল করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আগামীতে তার ভবিষ্যৎ কী হবে, সে নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তার বিরুদ্ধে হত্যা ও অপহরণে ভূমিকা রাখার অভিযোগে ১০০টিরও বেশি মামলা করা হয়েছে এবং বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সাম্প্রতিক বিক্ষোভের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ তুলে তদন্ত করা হচ্ছে। সেখানে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত ২০১৮ সালের সংশোধিত ট্র্যাভেল অ্যারেঞ্জমেন্ট অনুযায়ী, উভয় দেশের কূটনৈতিক ও অফিসিয়াল পাসপোর্টধারীরা ভিসা ছাড়াই ৪৫ দিন পর্যন্ত অন্য দেশে থাকতে পারেন। এরই মধ্যে তার ৩০ দিন পেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শেখ হাসিনা, তার উপদেষ্টা, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য এবং জাতীয় সংসদের সদস্য এবং জীবনসঙ্গীদের কূটনৈতিক পাসপোর্ট বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে। কূটনীতিকদের মধ্যে যাদের মেয়াদ শেষ হয়েছে, তাদের পাসপোর্টও বাতিল করা হয়েছে। এখন সাধারণ পাসপোর্ট পেতে অন্তত দুটি সংস্থার তদন্ত পার হতে হবে। এরমধ্যেই ভারত থেকে শেখ হাসিনা যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলেন; কিন্তু যুক্তরাজ্য তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে। যদিও তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় দাবি করেছিলেন, তার মা আশ্রয়ের জন্য কোথাও আবেদন করেননি।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে বহিঃসমর্পণ চুক্তি আছে তার আওতায় শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের সুযোগ রয়েছে। ওই চুক্তির অধীনে ভারত উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নিতে পেরেছিল। একইভাবে বাংলাদেশ জেএমবির কয়েকজন জঙ্গিকে ফিরে পেয়েছিল। যাদের বিরুদ্ধে মামলা আছে, মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন বা দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, তাদের প্রত্যর্পণের সুযোগ রয়েছে এই চুক্তির অধীনে। তবে শর্ত হলো, অপরাধটি উভয় দেশেই দণ্ডনীয় হতে হবে। আর যাদের মামলা ‘রাজনৈতিক প্রকৃতির’ তাদের ক্ষেত্রে এই চুক্তি প্রযোজ্য হবে না।

কোনো পরিস্থিতিতে ভারত বা বাংলাদেশ প্রত্যর্পণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারবে, সে কথাও বলা রয়েছে চুক্তির অষ্টম অনুচ্ছেদে। বলা হয়েছে, যদি কোনো অনুরোধ ‘সৎ উদ্দেশে নয়’ এবং ‘ন্যায়বিচারের স্বার্থে নয়’ বলে বিবেচিত হয়, সেক্ষেত্রে তা প্রত্যাখ্যান করা যেতে পারে। হত্যার মতো অভিযোগকে ‘রাজনৈতিক’ হিসেবে বিবেচনার সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে ভারত যদি মনে করে যে, প্রত্যর্পণের ওই আবেদন ‘ন্যায়বিচারের স্বার্থে নয়’, তাহলে তা প্রত্যাখ্যান করতে পারে।

বাংলাদেশ শেখ হাসিনাকে ফেরানোর জন্য ভারতকে অনুরোধ করবে কি না, সেই প্রশ্ন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্সেকে বলেছেন, স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয় যদি সিদ্ধান্ত নেয়, তবে শেখ হাসিনাকে ফেরানোর বিষয়ে (ভারতকে) আমাদের বলতে হবে। এটি ভারত সরকারের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি। ভারত এ বিষয়টি জানে এবং আমি নিশ্চিত তারা বিষয়টি বিবেচনা করবে।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার পতন ও দেশত্যাগের সিদ্ধান্তকে বাংলাদেশের আন্দোলনকারীরা উল্লাসের সঙ্গে স্বাগত জানালেও নয়াদিল্লি সেটি কোনোভাবেই নামতে পারছে না। কারণ নয়াদিল্লিতে বিজেপি এবং কংগ্রেস উভয় দলের সঙ্গে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্ক বাংলাদেশকে ভারতের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এবং সবচেয়ে বিশ্বস্ত আঞ্চলিক মিত্র হতে সাহায্য করেছিল। শেখ হাসিনার শাসনব্যবস্থা ক্রমবর্ধমান নিপীড়ক ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠলেও সে বিষয়ে নির্বিকার এবং চোখই ফিরিয়ে রাখে ভারত।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো শাফকাত মুনির বলেন, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক মূলত একটি ব্যক্তি এবং একটি দলের সঙ্গে সম্পর্ক হয়ে উঠে। এখন ভারতের এটা মেনে নেয়া দরকার যে শেখ হাসিনা চলে গেছেন, এখন সম্পর্কটিকে সম্পূর্ণরূপে পুনঃস্থাপন এবং পুনরায় চালু করতে হবে। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক সরকার পরিবর্তনের অস্থিরতার কাছে জিম্মি হতে পারে না।

তবে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের উপর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ভারতে শেখ হাসিনার বর্তমান উপস্থিতি। যদিও তার পরিবার বলছে, শেখ হাসিনা ভারতে স্থায়ীভাবে থাকবেন না এবং তার প্রত্যাবর্তনের জন্য বাংলাদেশ থেকে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যর্পণের অনুরোধ করা হয়নি।

ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞ তথা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আলী রিয়াজ বলেন, শেখ হাসিনার আকস্মিক পতনে ভারতকে একটি ‘গুরুতর গোয়েন্দা ব্যর্থতার’ মুখোমুখি হতে হয়েছিল। যার অর্থ উল্লেখযোগ্য আঞ্চলিক বিপর্যয়ের জন্য ভারত অপ্রস্তুত ছিল। ক্রমবর্ধমান ভারতবিরোধী মনোভাব এখন বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ভারত রাষ্ট্রীয় সম্পর্ককে গুরুত্ব না দিয়ে শেখ হাসিনা ও তার দলের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করে সব ডিম এক ঝুঁড়িতে রেখেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অত্যন্ত অলীক নীতি অনুসরণ করেছে। ফলস্বরূপ, ভারত এখন নিজেই একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে।

বিতর্কিত নির্বাচন এবং যারা শেখ হাসিনার শাসনের সমালোচনা করেছিলেন তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। জুলাইয়ে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার সেখানে নিষ্ঠুর বল প্রয়োগ করে। অনেক ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়। বন্দি করে মানুষের ওপর নির্যাতন করা হয়। প্রতিবাদ করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে ছাত্র-জনতা মারা যায়। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার সুবিধাভোগী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্য সোশ্যাল মিডিয়াকে তাদের নিজেদের অস্ত্রে পরিণত করেছিলেন। এটি ব্যবহার করে তাদের রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন করেছেন। মানুষ সড়কে চলাচল করতে গিয়ে তাদের মোবাইলে ম্যাসেনজার নিয়মিত দেখা হতো। মোবাইল ম্যাসেজিং অ্যাপে আন্দোলনকারীরা কোন চ্যানেল ফলো করে, সেটা খুঁজে বের করে পুলিশ ও র‌্যাবের কিছু সদস্য। কারও মোবাইলে আওয়ামী লীগ বিরোধী ম্যাসেজ দেখতে পেলেই তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত