নিহতদের স্মরণে শহীদি মার্চ পালন

বিচার চান শহীদ পরিবার

প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতন ঘটনাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত উত্তাল ছিল রাজধানীসহ সারা দেশ। রাজপথে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকাতে নির্বিচারে গুলি ছোড়া হয়। সেই গুলিতে শত শত মানুষ নিহত ও আহত হন। সর্বশেষ ৫ আগস্ট আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নিলে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। তখন বাংলার আকাশে-বাতাসে নেমে আসে আনন্দের উল্লাস। সেই ধারাবাহিকতায় গত জুলাই ও আগস্ট মাসে নিহতদের স্মরণে এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের এক মাসপূর্তি উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাজু ভাস্কর্যে ‘শহীদি মার্চ’ কর্মসূচি পালিত হয়। মার্চে অংশগ্রহণকারীদের হাতে ছিল জাতীয় পতাকা, জুলাই-আগস্টের নানা ঘটনার দৃশ্য সম্বলিত ব্যানার ও প্লেকার্ড।

কর্মসূচিতে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা উপস্থিত হয়ে স্লোগান দিচ্ছেন ‘লেগেছে রে লেগেছে রক্তে আগুন লেগেছে, রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে অন্যায়, জেগেছে রে জেগেছে, ছাত্র সমাজ জেগেছে, চলছে লড়াই চলবে আবু সাঈদ লড়বে, বিচার বিচার বিচার চাই খুনি হাসিনার বিচার চাই, ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই শেখ হাসিনার ফাঁসি চাই, খুনিদের চামরা তুলে নিবো আমরা, আবু সাঈদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ, শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দিবো না’।

ছাত্র-জনতার স্লোগানে রাজু ভাস্কর্য যখন মুখোরিত, ঠিক তখন রাজু ভাস্কর্যের কয়েকগজ দূরে রক্তমাখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন মো. আব্দুর রব মিয়া। তার দুচোখ দিয়ে তখন অঝোরে পানি পড়ছে। কারণ গত ৫ আগস্ট ছেলে মিরাজ হোসেন পাপ্পু (২৯) যাত্রাবাড়ীতে আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে মারা যায়। ছেলে মারা যাওয়ার একমাস পূর্ণ হলো এখনো তাদের খোঁজ কেউ রাখেনি। তাইতো গত বুধবার টেলিভিশনে ‘শহীদি মার্চ’ কর্মসূচির কথা শুনতে পেরে রাজু ভাস্কর্যে আসেন। গতকাল রাজু ভাস্কার্যের সামনে আব্দুর রব মিয়া আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ী থানায় সবচেয়ে নির্মম ঘটনা ঘটেছে, সারা বাংলাদেশের চেয়ে যাত্রাবাড়ীতে বেশি মানুষ মারা গেছে, আপনারা জানেন। আজকে একমাস হয়ে গেলেও ছাত্র আন্দোলনের কেউ আমাদের শহীদ পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। এবং গতকাল খবরের মাধ্যমে জানতে পেরেছি- এখানে (রাজু ভাস্কর্য) আহত ও নিহত শহীদ পরিবারকে আসতে বলেছে। যারা প্রতিবাদ করতে গিয়ে দেশের জন্য জীবন দিয়েছে তারা যেন শহীদি মর্যাদা পায় সেজন্য ছাত্র নেতাদের কাজ করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধা সম্মান পায়। সারা দেশের প্রতিটি এলাকায় এলাকায় ১০ থেকে ১২ জন ছাত্র মিলে একটা টিম করে দেয়া হোক- তারাই নিহত ও আহতদের তালিকা করবে।’

নিহত মিরাজ হোসেন পাপ্পুর বাবা বলেন, ‘স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে হটাতে শুধু একজন আবু সাঈদ মরেনি, খোঁজ নিয়ে দেখেন ডেমরা ও যাত্রাবাড়ীতে কত মানুষ মারা গেছে। ডেমরা পাড়াটগা কবরস্থানে দুজন শহীদ শুয়ে আছে, তাদের খোঁজ কেউ নেয়নি। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পতনের পরেও পুলিশ কেন বৃষ্টির মতো গুলি করলো? রাষ্ট্রের কাছে পুলিশের বিচার চাই। ছেলে হত্যার জন্য ডেমরা থানায় গিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করতে চেয়েছিলাম কিন্তু পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা নেয়নি পরে শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের ও আসাদুজ্জামান খান কামালসহ দশজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। মামলা করেছি- দশজনের বিরুদ্ধে কিন্তু মামলার এজাহারে আমার এলাকার আরো কয়েকজনের নাম ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন এলাকার ওইসব লোকজন আমার কাছে এসে হুমকি দিচ্ছে।’

কান্নাজড়িত কণ্ঠে আব্দুর রব মিয়া আরো বলেন, পাপ্পু আমার বড় ছেলে সে-ই আমাদের সংসার চালাতো, সেই ছেলের লাশ বাবার কাঁধে। মিডফোর্ড হাসপাতালে গিয়ে ছেলের লাশ পেয়েছি। আজকে আমার এখানে (রাজু ভাস্কর্য) আসার কথা ছিল না। আজকে কেন আসবো? এই ছাত্র আন্দোলনের ডাকে আমাদের ছেলেরা ঘর থেকে বেরিয়েছে, এক মাস হয়ে গেল কেন শহীদ পরিবারের খবর নেয়া হয়নি?

নিহত মিরাজ হোসেন পাপ্পুর বাবা আব্দুর রব মিয়ার মতোই মিরপুর-১ নম্বর থেকে শাহবাগে এসেছিলেন গত ১৯ জুলাই মিরপুরে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত হওয়া সজীবের (২০) মা জোবায়দা বেগম। দিনমজুর জোবায়দা বেগম ঠিকভাবে কথাও বলতে পারেন না। এরপরও টেলিভিশনে শহীদি মার্চ কর্মসূচির কথা শুনে শাহবাগে এসেছিলেন। কারণ তিনি জানতেন শাহবাগে হয়তো নিহতদের তালিকা তৈরি করা হবে। সেই তালিকায় যাতে তার শহীদ ছেলের নাম থাকে। কিন্তু শাহবাগে হাজার হাজার ছাত্র-জনতার ঢলে জোবায়েদা বেগমের খবর কেউ নেয়নি। ফলে হতাশা নিয়েই জোবায়দা বেগম মিরপুরের উদ্দেশে চলে যান। জোবায়দা বেগম বলেন, আমার ছেলে গার্মেন্টে কাজ করতো ১৯ জুলাই আন্দোলনে গিয়ে মিরপুর-১ নম্বরে পুলিশের গুলিতে মারা গেছে। সজীবের বাবা অসুস্থ হয়ে ঘরে শুয়ে আছে। এক মাসেও আমাদের কেউ খোঁজ নেয়নি। তবে আমার বাড়ির পাশে বিএনপির এক নেতা ১৬ বছর পর জেল থেকে বের হয়ে আমাকে বলছে- ছেলে নিহতের ঘটনায় থানায় মামলা করতে কিন্তু আমি মামলা করতে চাই না। আব্দুর রব মিয়া, জোবায়েদা বেগমের মতোই মুজিবর রহমান প্ল্যাকার্ড নিয়ে টিএসসি চত্বরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার প্ল্যাকার্ডে লেখা ‘প্রিয় দেশবাসী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র ভাই ও বোনেরা আমি একজন গরিব অসহায় পিতা গত ১৯ জুলাই শুক্রবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় আমার ছেলে মিরপুর-১০ নম্বরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন সময় বুকের বাম পাশ ও পিছনে পিঠের নিচে গুলিবিদ্ধ হয়। মিরপুর-১০ নম্বরে আজমল হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে পরে তাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে জরুরি বিভাগে পাঠানো হয়। হাসপাতালের চিকিৎসকরা দেখে ছেলেটিকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। আমি অসহায় পিতা সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল থেকে ছেলেকে এনে ভাষানটেক বস্তির পুনর্বাসন কোয়ার্টারের বিআরপি কবরস্থানে দাফন করা হয়। পিতা বলে আমার ছেলের খুনির বিচার চাই এবং আমি কি আমার সন্তানের ক্ষতিপূরণ পাবো না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ও দেশবাসীর কাছে সেটি জানতে চান মুজিবুর রহমান।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার কর্মসূচিতে ‘আবু সাঈদ-মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’, ‘শহীদদের স্মরণে, ভয় করি না মরণে’, ‘শহীদদের রক্ত, বৃথা যেতে দেবো না’, ‘রক্তের বন্যায়, ভেসে যাবে অন্যায়’, ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন ভারতে’, ‘সরকার কী করে, হাসিনা ভারতে’, ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে শুরু হয়ে নীলক্ষেত, নিউমার্কেট, কলাবাগান, ধানমন্ডি, সংসদ ভবন, ফার্মগেট, কাওরানবাজার ও শাহবাগ হয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে শহীদি মার্চ কর্মসূচি শেষ হয়।