শেখ হাসিনার নামে ১১৯ হত্যা মামলা
প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে সংঘাত-সংঘর্ষে মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে ১১৯টি হত্যা মামলা হয়েছে। এর বাইরে হত্যাচেষ্টা ও অপহরণের অভিযোগে আরো ১১টি মামলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে সব মিলিয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা দাঁড়ালো ১৩০। ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন। এরপর ১৩ আগস্ট থেকে একের পর এক মামলা হতে থাকে। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত সাবেক মন্ত্রী উপদেষ্টা, আইজিপি, সরকারি কর্মকর্তাসহ ২৩ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষ-সংঘাতে এখন পর্যন্ত ৭৬০ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। ১৬ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত ৩৪১ জন এবং ৪ আগস্ট থেকে ২৩ আগস্ট পর্যন্ত ৪১৯ জন নিহত হন।
এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১১৯টি হত্যা মামলা হয়েছে। আসামি করা হয়েছে শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এবং সাবেক মন্ত্রী, আওয়ামী লীগ নেতা, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি), সাবেক সরকারি কর্মকর্তা, আইনজীবী, ব্যবসায়ী ও সাংবাদিক। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে। মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, আন্দোলনের সময় নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচার গুলি চালিয়েছেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ এবং পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবের সদস্যরা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তারা হুকুমদাতা, অর্থদাতা এবং পরিকল্পনাকারী।
২৫ দিনের রিমান্ডে আনিসুল-সালমান : শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রথম গ্রেপ্তার হন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। গত ১৩ আগস্ট তাদের রাজধানীর সদরঘাট থেকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানায় পুলিশ। পরদিন তাদের নিউমার্কেট থানার একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। প্রথম দফায় ১০ দিনের রিমান্ড শেষে তাদের আবার ২৪ আগস্ট ঢাকার আদালতে তোলা হয়। সেদিন দ্বিতীয় দফায় লালবাগ ও নিউমার্কেট থানার দুটি মামলায় আবার পাঁচ দিন করে ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। এই রিমান্ড মঞ্জুরের পাঁচ দিনের মাথায় তাদের আদালতে তোলা হয়। সেদিন বাড্ডা থানার আরেকটি খুনের মামলায় তৃতীয় দফায় পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়। এ নিয়ে পৃথক চারটি হত্যা মামলায় তাদের ২৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের প্রভাবশালী এই দুই নেতা এখনো রিমান্ডে আছেন।
২০ দিন রিমান্ডে টুকু ও পলক : আনিসুল ও সালমানের পর ১৪ আগস্ট গ্রেপ্তার হন সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু ও জুনাইদ আহামেদ পলক। পরদিন তাদের পল্টন থানার হত্যা মামলায় ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়। আট দিন রিমান্ডে শেষে আবার তাদের ২৫ আগস্ট আদালতে তোলা হয়। সেদিন দ্বিতীয় দফায় তাদের আবার লালবাগ থানার একটি হত্যা মামলায় সাত দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। এরপর ১ সেপ্টেম্বর টুকু ও পলককে আবার আদালতে আনা হয়। তৃতীয় দফায় তাদের অন্য হত্যা মামলায় তিন দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। মোট ২০ দিনের রিমান্ডে তারা এখনো পুলিশ হেফাজতে আছেন।
দফায় দফায় রিমান্ডে তারা : গত ১৯ আগস্ট গ্রেপ্তার হন সাবেক মন্ত্রী দীপু মনি ও সাবেক উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়। পরদিন প্রথম দফায় মোহাম্মদপুর থানার একটি হত্যা মামলায় দীপু মনির চার এবং আরিফের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়। এরপর গত ২০ আগস্ট গ্রেপ্তার হন সাবেক সংসদ সদস্য আহমদ হোসেন। পল্টন থানার একটি মামলায় প্রথম দফায় তার চার দিনের রিমান্ড হয়। আহমদ হোসেন গ্রেপ্তারের দুই দিন পর ২২ আগস্ট গ্রেপ্তার হন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। এর পরদিন নিউমার্কেট থানার একটি হত্যা মামলায় তার প্রথম দফায় পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়। দ্বিতীয় দফায় ২৭ আগস্ট মেননের ছয় দিনের রিমান্ড হয়। সর্বমোট ১১ দিনের রিমান্ডে আছেন তিনি।
মেনন গ্রেপ্তার হওয়ার এক দিন পর গত (২৩ আগস্ট) সাবেক চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ গ্রেপ্তার হন। পরদিন ভাটারা থানার একটি হত্যা মামলায় প্রথম দফায় তার সাত দিনের রিমান্ড হয়। প্রথম দফা রিমান্ড শেষে দীপু মনিকে আবার ২৪ আগস্ট আদালতে তোলে পুলিশ। সেদিন ভাটারা থানার মামলায় দ্বিতীয় দফায় তার চার দিনের রিমান্ড হয়। দুই দফায় দীপু মনির আট দিনের রিমান্ড হয়েছে। ২৫ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় আহমদ হোসেন ও আরিফ খানকে লালবাগ থানার মামলায় সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়।
তৃতীয় দফায় লালবাগ থানার হত্যা মামলায় ১ সেপ্টেম্বর আরিফ খানের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়। সব মিলিয়ে আরিফ খানকে ১৫ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
আর তৃতীয় দফায় আদাবর থানার মামলায় আহমদ হোসেনের তিন দিনের রিমান্ড হয়। মোট ১৪ দিনের রিমান্ড হয় তার। এ ছাড়া আ স ম ফিরোজের গত ৩১ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় ভাটারা থানার মামলায় তিন দিনের রিমান্ড হয়। সব মিলিয়ে ১০ দিনের রিমান্ডে ছিলেন ফিরোজ।
এ ছাড়া গত ২৬ আগস্ট গ্রেপ্তার হন জাসদ সভাপতি, সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। পরদিন প্রথম দফায় তার সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়। গত মঙ্গলবার আরেকটি হত্যা মামলায় তার পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে।
এ ছাড়া সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি গ্রেপ্তার হন গত ২৮ আগস্ট। পরদিন প্রথম দফায় একটি হত্যা মামলায় তাকে চার দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ।
অন্য যারা রিমান্ডে : আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য আবদুস সোবহান গোলাপ গ্রেপ্তার হন গত ২৫ আগস্ট। পরদিন আদাবর থানার একটি হত্যা মামলায় প্রথম দফায় সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়। এরপর একই হত্যা মামলায় দ্বিতীয় দফায় তার তিন দিনের রিমান্ড হয়। সব মিলিয়ে ১০ দিনের রিমান্ডে আছেন তিনি।
সাবেক সংসদ সদস্য সাদেক খান গ্রেপ্তার হন গত ২৪ আগস্ট। পরদিন মোহাম্মদপুর থানার একটি হত্যা মামলায় প্রথম দফায় তার চার দিন রিমান্ড হয়। দ্বিতীয় দফায় আদাবর থানার একটি হত্যা মামলায় গত ২৯ আগস্ট সাদেকের রিমান্ড মঞ্জুর হয় পাঁচ দিন। মোট ৯ দিন রিমান্ডে আছেন সাদেক। সাবেক সংসদ সদস্য হাজী সেলিমকে গ্রেপ্তার হন ২ সেপ্টেম্বর। লালবাগ থানার একটি হত্যা মামলায় পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয়ার পরদিনই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। গতকাল তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা রিমান্ডে : ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসান গ্রেপ্তার হন ১৬ আগস্ট। তিন দফায় জিয়াউল আহসান ২৩ দিনের রিমান্ডে আছেন। আর নৌবাহিনীর রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মোহাম্মদ সোহায়েল গ্রেপ্তার হন ২০ আগস্ট। দুই দফায় সোহায়েল রিমান্ডে আছেন ১১ দিন।
সাবেক দুই আইজিপি একেএম শহীদুল হক ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন গ্রেপ্তার হন গত মঙ্গলবার। গতকাল পৃথক দুটি হত্যা মামলায় শহীদুলের সাত এবং মামুনের আট দিন রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। একই দিন আরেকটি হত্যা মামলায় ব্যবসায়ী দিলীপ কুমার আগারওয়ালা গ্রেপ্তার হয়ে তিন দিনের রিমান্ডে রয়েছেন। রাজনৈতিক নেতা ও সরকারি কর্মকর্তাদের বাইরে গত ২১ আগস্ট দুজন সাংবাদিকও গ্রেপ্তার হয়েছেন। শাকিল আহমেদ ও ফারজানা রুপা দম্পতিকে দুটি হত্যা মামলায় ৯ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তারা এখন কারাগারে।