ঢাকা ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ভয়ংকর রূপে ফিরছে এডিস

ভয়ংকর রূপে ফিরছে এডিস

প্রত্যেক বছরের মতো এ বছর এডিস মশার প্রকোপ বেড়েছে রাজধানীজুড়ে। এর মধ্যেই এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন মানুষের মৃত্যু ঘটছে। এভাবে চলতে থাকলে সেপ্টম্বরের শেষার্ধে এবং অক্টোবর মাসজুড়ে ডেঙ্গুতে মানুষের মৃত্যু আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে পারে।

গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় তিনজনের মৃত্যু হয়। এই সময়ে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি নতুন রোগীর সংখ্যা ৪০৩। এ নিয়ে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৯৫ জনের এবং হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৫ হাজার ২০৭ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, সারা দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ১ হাজার ৫০৯ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছে। এর মধ্যে ঢাকায় ৮৯০ জন আর বাকি ৬১৯ জন ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিভাগে। তবে এটা ডেঙ্গু রোগীর আসল চিত্র নয়। যদি এডিস মশা একজনকে কামড় দেয়, তাহলে ১০০ জনের দেহে ডেঙ্গুর জীবাণু ঢুকবে। হয়তো মাত্র ২০ জনের দেহে এর লক্ষণ ফুটে উঠবে, বাকি ৮০ জনের মধ্যে ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা যাবে না। তাদের বলা হয় লক্ষণবিহীন বা অ্যাসিম্পটোমেটিক ডেঙ্গু রোগী। আবার লক্ষণধারী ২০ জনের মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশের দেহে ডেঙ্গুর মৃদু লক্ষণ থাকে। অনেকে এজন্য চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে প্যারাসিটামল-জাতীয় ওষুধ খেয়ে থাকেন এবং অধিকাংশ সময় সুস্থ হয়ে যান। আবার রাজধানীর বহু হাসপাতাল ও রোগনির্ণয় কেন্দ্র থেকে ডেঙ্গু আক্রান্তের তথ্য আসে না। অনেকে আক্রান্ত হয়ে বাসায়ও চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। এ সংখ্যাটা আক্রান্তের মোট তালিকায় নেই।

চলতি অর্থবছরে ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মশানিধনে ১৫২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা বাজেট ধরা হয়েছে। এরমধ্যেই উত্তরের ১২১ কোটি ৮৪ লাখ এবং দক্ষিণের ৩১ কোটি ১ লাখ টাকা। আর গত ১২ বছরে ঢাকার মশা মারার আয়োজনে খরচ হয়েছে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এই বাজেটের টাকা মশা নিবারণের নানা যন্ত্রপাতি, কীটনাশসহ আরো অনেক কাজে ব্যয় হয়। বছরে বছরে মশানিধনে বাজেট বাড়ানো হয়; কিন্তু কার্যকরী উদ্যোগের অভাব রয়ে যায়। যার কারণে মশার উপদ্রব বাড়ছে।

জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি কর্পোরেশনে মশা নিধন ওষুধ আমদানি এবং মাঠপর্যায়ে ওষুধ ছিটানোর কাজে গাফলতি আছে। ঠিকমতো মশার ওষুধ ছিটানো হয় না। আবার যেসব জায়গায় মশার বংশোবিস্তার এবং মশার উপদ্রব বেশি সেখানে কখন কখন ওষুধ ছিটানো সম্ভব হয় না। কারণ বহুতল ভবনগুলো এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে, চারপাশে যতটুকু ফাঁকা জায়গা রয়েছে, সেখানে একজন মশকনিধনকর্মী পৌঁছাতে পারেন না। জমে থাকা পানিসহ বিভিন্ন স্থানে ডেঙ্গুবাহী এডিস মশা বংশোবিস্তার ঘটায়। এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। আক্রান্ত হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জুন থেকে মূলত ডেঙ্গু মৌসুম শুরু হয়; সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায়। এবারও জুলাই থেকে ডেঙ্গু বাড়ছে। বৃষ্টি থামার পর মূলত মশার উপদ্রব বাড়ে। এবারও এ লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এ ব্যাপারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার জানান, গত বছরের তুলনায় এ বছরে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং বরিশাল বিভাগে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তে পারে। কারণ চলতি বছরের মার্চে মাঠপর্যায়ে গবেষণা করে দেখা যায়- এবার ডেঙ্গু পরিস্থিতি এসব ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগে খারাপ হবে। এডিস মশার ঘনত্ব, বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, আদ্রতা, ডেঙ্গু রোগী বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়া হয়। মার্চ মাসের হিসেবে এবার শীতকালেও এডিস মশার ঘনত্ব ১০-এর উপর।

অধ্যাপক কবিরুল বাশার আরো জানান, মানুষ এডিস মশা চেনে এবং প্রতিরোধে কী করতে হয় তাও জানেন। তারপরও তারা বাড়িঘর পরিষ্কার করেন না। স্বচ্ছ পানি জমতে দেন। এতে এডিস মশার বংশোবিস্তার ঘটছে। আর সিটি কর্পোরেশনের মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ নেই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত বছর প্রথম তিন মাসে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয় ৯ জনের। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ডেঙ্গুতে ২২ জনের মৃত্যু হয়। যা গত বছরের একই সময়ে দ্বিগুণের বেশি। এ বছর একই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি। গত বছর প্রথম তিন মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৮৪৩ জন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। এবার প্রথম তিন মাসে ১ হাজার ৭০৫ জন ভর্তি হয়েছেন। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, এডিস মশার কামড়ে প্রতি বছর মানুষ ডেঙ্গুতে হচ্ছেন। রোগীরা চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে ছুঁটছেন। সেদিক থেকে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশের চিকিৎসকরা এখন যথেষ্ট দক্ষ হয়ে উঠেছেন। হাসপাতালগুলোতেও ব্যবস্থাপনা এখন ভালো। তারপরও প্রস্তুতি প্রয়োজন। ডেঙ্গু রোগীদের সার্বক্ষণিক চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখতে জেলা ও উপজেলার সব হাসপাতালে আগাম প্রস্তুতি দরকার। সেই সঙ্গে দরকার মানুষকে সচেতন।

ডেঙ্গু এখন সারা বছরের রোগ এবং সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে এমন মন্তব্য করে তিনি ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, আবহাওয়া, জলবায়ু পরিস্থিতি এবং মশার ঘনত্ব ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের চোখ রাঙানি দিচ্ছে। সতর্ক না হলেই বিপদ। জনসচেতনতার অভাবে আমাদের সমাজে অনেক কিছু ঘটে, যা একটু সচেতন হলেই রোধ করা যায়। তাই সব ক্ষেত্রে এ বোধটুকু পুষ্ট করা খুব জরুরি। প্রথমবার ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর ঝুঁকি কম থাকলেও কারও দেহে দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু হলে তীব্রতা সাধারণত বেশি হয়। ফলে মৃত্যুহারও বেশি হয়। ডেঙ্গুর মৃদু লক্ষণ দেখার পর অনেকেই সতর্ক হন না। প্রধানত দুই ধরনের ডেঙ্গু আছে। প্রথমত, হেমোরেজিক বা রক্তক্ষরা ডেঙ্গু; দ্বিতীয়ত, সনাতন বা ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু। রক্তক্ষরার ক্ষেত্রে দেখা যায়, রোগীর তীব্র ব্যথা হয়তো নেই। প্যারাসিটামল-জাতীয় ওষুধ খেয়ে রোগী স্বস্তি পান। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অনেক সময় প্লাটিলেট কাউন্ট কমে এবং হঠাৎ রক্ষক্ষরণ শুরু হয়। রক্তক্ষরণ মানে পানিশূন্যতা সৃষ্টি। যেকোনো স্থানে রক্তক্ষরণ ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি মস্তিষ্কেও তা হতে পারে। ফলে রোগীকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। রক্তক্ষরণ না হলেও প্লাটিলেট কমে গিয়ে রক্তনালিগুলো থেকে তরল পদার্থ বেরিয়ে এসে শরীরের বিভিন্ন ফাঁকা জায়গা যেমন ফুসফুস বা পেটে জমা হয়। ফলে রোগীর শ্বাসতন্ত্রে জটিলতা শুরু হয়ে বিপজ্জনক অবস্থায় চলে যায়। ডেঙ্গু হলে যত মৃদু লক্ষণই থাক, পরীক্ষা করাতে হবে। প্রয়োজনে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত