ঢাকা ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বন্যায় সব হারিয়ে নিঃস্ব মানুষ

সবকিছু এলোমেলো উদ্যোক্তাদের
বন্যায় সব হারিয়ে নিঃস্ব মানুষ

দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ১১ জেলায় বন্যার পানি কমায় ক্ষতির পরিমাণ সামনে আসতে শুরু করেছে। সড়ক, বাড়িঘর, ফসল ও খামারিদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ফুটে উঠছে ক্ষতচিহ্ন।

দেশের পূর্বাঞ্চলের ১১টি জেলায় (ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজার) ১৫ দিনের বেশি সময় ধরে বন্যা পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল। এখন অবশ্য এসব জেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম বালিয়ারা। সেই গ্রামে বাস করেন পারভীন বেগম। স্বামী মারা গেছেন ১০ বছর আগে। একমাত্র ছেলে সন্তানকে নিয়ে ছোট দুটি মাটির ঘরে কোনোমতে চলে যাচ্ছিল জীবন। কিন্তু এক সন্ধ্যায় বন্যায় কেড়ে নিয়ে গেছে তার সেই মাথা গোজার ঠাঁই। পারভীন বেগম বলেন, আমি গ্রামে গ্রামে ভিক্ষা করে চাল ও কিছু টাকা পাই, তা দিয়ে মা-ছেলে চলি। থাকতাম দুটি মাটির ঘরে। ২৩ আগস্ট রাতে আমাদের ঘরে পানি উঠে যায়। পরনের কাপড়েই ঘর থেকে বের হয়ে যাই। পাশের একটি বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেই। পরে এসে দেখি আমার ঘর নাই, পানি নিয়ে গেছে। পানি কমার পর শুধু টিনের চালগুলো ছাড়া আর কিছুই রইলো না। এখন থাকি একজনের বাড়িতে, আর ছেলে থাকে আরেকজনের বাড়িতে। মেম্বারের কাছে গেছিলাম, তিনি বললেন, সরকারি ঘর যদি আসে তাহলে আমার নাম দেবেন। তা কবে আসবে নিশ্চিত না। শুধু পারভীন বেগম না। এমন আরো অনেকে আছেন কষ্টের মধ্যে। বন্যার পানি কমে যাওয়ার পর ভেসে উঠছে ক্ষতচিহ্ন। টিনের ঘর, মাটির ঘর, সেমিপাকা ঘর, কালভার্ট, গ্রামীণ সড়ক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হারিস মিয়া নামের এক শ্রমিক বলেন, বন্যায় ঘর ভেঙে নিয়ে গেছে। এখন পরিবার নিয়ে অন্যের বাড়িতে থাকি। সবাই শুধু চিড়ামুড়ি ও চাল নিয়ে আসে। আমি পরিবার নিয়ে থাকবো কোথায়? ঘর নির্মাণ করার মতো টাকা তো আমার কাছে নাই।

এ বিষয়ে কসবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহরিয়ার মোক্তার বলেন, প্রথম দিকে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দিয়েছি। পরবর্তীতে পরিবারগুলোকে নগদ দুই হাজার টাকা করে সহায়তা দেয়া হচ্ছে। আর ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর নির্মাণে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগে বলেছি। এক হাজার বান্ডিল টিন ও নগদ অর্থ চেয়েছি, যদি এগুলো বরাদ্দ দেয় তাহলে ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণে সহায়তা করা যাবে।

এতো গেল শুধু পারভীন বেগমের জীবনের কাহিনী। ভারতের উজানের ঢল ও টানা বৃষ্টিপাতের কবলে পড়ে এমন লাখো মানুষের জীবন সর্বশান্ত হয়েছে। শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে এখন অন্ধকারে দিন কাটাচ্ছেন। তেমনি জুলফিকার আলী জিসান (২৫)। লেখাপড়া শেষ করে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। মাছচাষে স্বপ্ন পূরণে সফলও হন তিনি। হঠাৎ বন্যা সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছে তার জীবন। জিসান বলেন, মা আর বড় বোনের ১০ ভরি স্বর্ণালংকার বিক্রি করে শুরু করেন মৎস্য ব্যবসা। আশা ছিল ব্যবসার মুনাফা দিয়ে সেগুলো শোধ করবেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, সব ছিনিয়ে নিঃস্ব করে দিলো বন্যা।

সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, প্রকল্পের দিকে অপলক তাকিয়ে বসে আছেন জিসান। চোখে-মুখে হতাশার ছাপ। কয়েকজন কর্মচারী প্রকল্পের ভেঙে যাওয়া পাড় মেরামত করছেন। বন্যার পানির প্রবল স্রোতে প্রকল্পের সব পাড়ই ভেঙে গেছে।

তবে একটু ভিন্নতা দেখা গেছে খুলনার দাকোপ উপজেলায় ঢাকি নদীর ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধ আবারো মেরামত করার চেষ্টা করছেন শত শত গ্রামবাসী। গতকাল শনিবার ভাটার টানে পানি নেমে যাওয়ার পরপরই পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহায়তায় বাঁধ মেরামত করতে শুরু করেন তারা। ভাঙন এলাকায় থাকা খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম বলেন, জায়গাটি ঝুঁকিপূর্ণ থাকায় আমাদের তত্ত্বাবধানে সংস্কার কাজ চলমান অবস্থায় বাঁধটি ভেঙে গেছে, আশা করছি রাতের মধ্যে আটকাতে সক্ষম হবো।

ভোলার বোরহানউদ্দিনের সাচড়া ইউনিয়নে প্রায় ২৭ বছরের পুরোনো বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধের বিভিন্ন অংশে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে করে হুমকির মুখে পড়েছে হাজার হাজার বসতঘর, ফসলি জমি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, লঞ্চঘাটসহ সরকারি বিভিন্ন স্থাপনা। স্থানীয়দের দাবি দীর্ঘদিন ধরে মেরামত না করায় তেঁতুলিয়া নদীর অতি জোয়ারের চাপে বেড়িবাঁধটির বিভিন্ন পয়েন্টে ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। দ্রুত মেরামত ও স্থায়ীভাবে সিসি ব্লক দ্বারা শক্ত বাঁধ নির্মাণের দাবি তাদের।

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম। তিনি বলেছিলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো পুনর্বাসনে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। এর আগে, বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের সমন্বয়ক, আইএলওর কান্ট্রি ডিরেক্টর, আইওএম চিফ অব মিশন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি, ডাব্লিউএফপির ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর, ইউনিসেফের ডেপুটি রিপ্রেজেন্টেটিভ, ইউএনআরসিও হিউম্যান্টেরিয়ান অ্যাফেয়ার অ্যাডভাইজারের সঙ্গে বৈঠক করেন উপদেষ্টা। বন্যার্তদের পুনর্বাসনে সহায়তার জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এগিয়ে এসেছে। ইউএন (জাতিসংঘ) বডির আটটি নানা রকমের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সভা করেছি। তারা পুনর্বাসন কাজে যুক্ত হওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত