রাষ্ট্র সংস্কার প্রসঙ্গে ড. ইউনূস

এ সুযোগ হাতছাড়া হলে দেশের ভবিষ্যৎ থাকবে না

শিক্ষার্থীদের প্রধান উপদেষ্টা : অন্তর্বর্তী সরকার সীমা অতিক্রম করলে স্মরণ করিয়ে দিও

প্রকাশ : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বাংলাদেশের জন্ম থেকে ৫৩ বছরে রাষ্ট্র সংস্কারের সুযোগ আর আসেনি। যে সুযোগ তোমরা (বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা) আমাদের দিয়েছো, এ সুযোগ যেন হাতছাড়া না হয়। এ সুযোগ হাতছাড়া হলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ থাকবে না। এটা কোনো রাষ্ট্র আর থাকবে না। এটা যেন শুধু রাষ্ট্র নয়, পৃথিবীর সম্মানিত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, সেই লক্ষ্যে কাজ করতে হবে।

গতকাল রোববার তেজগাঁও অবস্থিত প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে ছাত্র সংগঠক এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র প্রতিনিধিদের সাথে এক মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন নিয়ে ছাত্র-জনতা প্রাণ দিয়েছে তা বাস্তবায়নের প্রতিজ্ঞা পুনর্ব্যক্ত করে ড. ইউনূস বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু হয়েছে। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে ছাত্রদের সার্বক্ষণিক কাজ করতে হবে। কাজেই যে কাজ শুরু করেছো, তা সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত বেরিয়ে যেও না।

সভার শুরুতে প্রধান উপদেষ্টা ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ ও আহত শিক্ষার্থীদের কথা গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। এ সময় হতাহতদের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন ড. ইউনূস।

আহতদের দেখতে হাসপাতালে যাওয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যখন হাসপাতালে তাদের দেখার জন্য যাই, তাকাতে কষ্ট হয়। একটা ছেলে, একটা মেয়ে এইরকমভাবে কীভাবে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এই দিকে পা চলে গেছে, ওইদিকে...’ এ কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন ড. ইউনূস। আপ্লুত কণ্ঠে তিনি বলেন, একজন তাজা তরুণ রংপুরে আমাকে বললো, ফুটফুটে একটা ছেলে- স্যার, আমি সারাজীবন ক্রিকেট খেলতে চেয়েছিলাম। ক্রিকেটার হতে চেয়েছিলাম। এখন দেখেন আমার পা কেটে ফেলেছে কেঁদে ফেলেছে। ওই পা রাখার উপায় ছিল না। সে আমাকে জিজ্ঞেস করেছে- স্যার, ক্রিকেট খলেবো কী করে। ক্রিকেট তার মাথা থেকে যাচ্ছে না, পা নাই যতবার দেখি, ততবার মনের সঙ্গে প্রশ্ন জাগে, এটিই আমরা বাংলাদেশ বানিয়েছি যে, এতগুলো তাজা প্রাণ, তাদের ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে, আমরা যারা আজকে এখানে বসে কথা বলছি, তাদের একমাত্র দায়িত্ব তাদের এই ত্যাগ, এই জীবনের বিনিময়ে তারা আমাদের এখানে বসার সুযোগ দিয়েছে, তারা না গেলে আমরা আজকে এখানে বসতে পারতাম না সবাই, আমরা সরকারের মধ্যে বসেছি, কেউই একই ভূমিকায় আসতে পারেতাম না।

ড. ইউনূস বলেন, কালকে একটা হাসপাতালে গেলাম, আবার সেই দৃশ্য কচি কচি প্রাণ, মাথার খুলি উড়ে গেছে। মাথার অর্ধেক নাই, গুলি মাথার ভেতর রয়ে গেছে। রংপুরের হাসপাতালের দৃশ্য, এক্সরে দেখা হচ্ছে- ওখানে দাগ ছোট ছোট ফুটো করা, আমি বুঝতে পারলাম না, আমাকে কী দেখাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এগুলো কী, এতগুলো গুলি তার শরীরে রয়ে গেছে, সে বেঁচে আছে। রাবার বুলেট যতবার দেখি যতবার শুনি, আবার নতুন করে প্রতিজ্ঞা করতে হয়, যে স্বপ্নের জন্য তারা প্রাণ দিয়েছে সেই স্বপ্নকে আমরা বাস্তবায়ন করবো। এটার থেকে আমাদের বেরিয়ে যাবার উপায় নেই। আমাদের যোগ্যতা না থাকতে পারে, ক্ষমতা না থাকতে পারে, কিন্তু আমাদের প্রতিজ্ঞা রইলো, আমরা এটা করবো। আমি খালি দেখি, এই যে দৃশ্য দেখলাম- এটা তো সবাই দেখছে না, যারা হাসপাতালে আসছে তারা দেখছে। প্রতিদিনের ঘটনা, মানুষকে জানাতে হবে, বোঝাতে হবে।

গত ১৫ বছরের অপশাসনের কথা স্মরণ করে শিক্ষার্থীদের অধ্যাপক ইউনূস বলেন, এতদিন তারা চুপচাপ শুয়ে শুয়ে স্বপ্নের মধ্যে ছিলো এবং আনন্দ সহকারে লুটপাট করে যাচ্ছিলো। এরা এখন চুপচাপ বসে থাকবে না। তারা খুব চেষ্টা করবে আবার তোমাদের দুঃস্বপ্নের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়ার। চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখবে না। কাজেই যে কাজ শুরু করেছো, তা সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত বেরিয়ে যেও না।

বাংলাদেশকে বিশ্বে অনন্য রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের কথা জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যেহেতু তরুণরা এটার (বাংলাদেশের) হাল ধরেছে, এ কারণেই এটা অনন্য। অনন্য একটা দেশ আমরা তৈরি করতে চাই। দুনিয়ার মানুষ এটা এসে দেখে যাবে। তোমাদের কাছে শিখতে আসবে, তোমাদের নিয়ে যাবে। বলবে, কী মন্ত্র দিয়ে তোমরা এটা করেছো।

বৈষম্য-অবিচার-লুটপাটের বিরুদ্ধে তরুণদের সংস্কারের চেতনা ধরে রাখার আহ্বান জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, এই মন্ত্র হয়তো তোমরাও টের পাচ্ছো না। মন্ত্রটা কীভাবে এলো। এটা একটা বিরাট মন্ত্রের মতো কাজ করেছে। এই মন্ত্রকে ধরে রাখবে। এই মন্ত্র যদি শিথিল হয়ে যায়, আমাদের কাজ শেষ করতে পারবো না। সেই দুঃখ যেন আমাদের দেখতে না হয়।

অন্তর্বর্তী সরকার ছাত্র-জনতার স্বপ্ন থেকে দূরে সরে গেলে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তোমরা নিজ নিজ চিন্তায় অনড় থাকো, যে যতই পরামর্শ দিক এটা থেকে বেরিয়ে আসার। এই পরামর্শ তোমরা গ্রহণ করো না। তোমাদের চিন্তা স্বচ্ছ, তোমাদের চিন্তা সঠিক।

ড. ইউনূস বলেন, আমাদের স্মরণ করিয়ে দেবে যদি আমরা এই স্বপ্ন থেকে দূরে সরার কোনো কাজ করি। আমাদের কারো কোনো ইচ্ছে নেই এই স্বপ্নের বাইরে যাওয়ার। স্বপ্ন বাস্তবায়ন করাই হবে সার্বক্ষণিক কাজ। তবে কোনো কারণে যদি আমরা সীমা অতিক্রম করি কোথাও, আমাদের সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দিও।