বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতনের পর ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নিয়েই আইনশৃঙ্খলা, অর্থনীতি, দ্রব্যমূল্য কমানো এবং আকস্মিক বন্যার মোকাবিলা করতে হয়েছে। সবকিছু সামলিয়ে রাষ্ট্র সংস্কার, কূটনৈতিক সাফল্য ও আস্থা অর্জনে এগিয়ে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার।
গত ৮ আগস্ট শপথ নেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ১৪ উপদেষ্টা। পরদিন শুক্রবার প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্যান্য উপদেষ্টাদের দপ্তর বণ্টন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। পরে ১১ আগস্ট শপথ নেন উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা ও বিধান রঞ্জন রায় আর ১৩ আগস্ট শপথ নেন আরেক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম। ১৬ আগস্ট বিকালে আরো চার উপদেষ্টা শপথ নিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তাদের শপথ পাঠ করান। বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ২১ জন।
অন্তর্বর্তী সরকারের একমাসে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য- আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গণহত্যার বিচারের উদ্যোগ, গণহত্যার তদন্ত করতে জাতিসংঘের সহায়তা গ্রহণ, গণভবনকে জাদুঘরে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত, সম্পূর্ণ বিচার না হওয়া পর্যন্ত ফ্যাসিবাদীদের পুনর্বাসন না করা, গুম থেকে সব ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক কনভেনশন সনদে স্বাক্ষর, সংস্কার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাব গ্রহণ, নিত্যপণ্যের মূল্য সহনীয় রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ, আলু-পিঁয়াজের আমদানি শুল্ক কমানো, অগ্নিকাণ্ডে দুটি স্টেশন ক্ষতির কারণে প্রায় একমাস বন্ধ থাকার পর মেট্রোরেল চালুকরণ, কালো টাকা সাদা করার বিধি ও রীতি বন্ধ করে দেয়া, ব্যাংকিং খাতের লুটপাট করা টাকা ফেরত আনতে পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন, পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে বিভিন্ন দেশের কাছে সহায়তা চাওয়া, দুর্নীতি, পাচার ও লুটপাটের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হিসাব ও সম্পদ জব্দ করার পাশাপাশি বিচারের আওতায় আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরইমধ্যে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। এর মধ্যে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে গণহত্যার শিকার ব্যক্তিদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ, আর্থিক খাতের দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ এবং ব্যাংক কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত উল্লেখযোগ্য। দুর্নীতি ও অর্থ পাচারে অভিযুক্ত প্রভাবশালী দেড়শ’ ব্যক্তির তালিকা তৈরি ও ৭৯ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু; ১৫ শতাংশ হারে আয়কর পরিশোধ করে অপ্রদর্শিত পরিসম্পদ অর্থাৎ কালোটাকা সাদা করার বিধান বাতিল; দায়মুক্তি আইন নামে পরিচিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ (সংশোধিত ২০২১)-এর অধীন চলমান সব কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা; গণশুনানি ছাড়া নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি না করার সিদ্ধান্ত; রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেয়া প্রকল্প কিংবা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) যাওয়ার প্রক্রিয়াধীন আছে এমন প্রকল্প পুনরায় যাচাই-বাছাই করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
ছাত্র-জনতা ও পুলিশের সংঘর্ষে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কাজ শুরু করে অন্তর্বর্তী সরকার। এক মাস পেরিয়ে গেলেও পুলিশের মনোবল এখনো পুরোপুরি ফেরেনি। এরই মধ্যে পুলিশ প্রশাসনে এসেছে বড় রদবদল। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে, কারণ বেশ কিছু মহল এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তাদের স্বার্থ সিদ্ধির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ড. মুহম্মদ ইউনূস গুরুত্বপূর্ণ সরকারি সংস্থাগুলোতে বড় আকারে সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক অর্থনীতিবিদকে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পদে নিয়োগ দিয়েছেন যাতে ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারেন। একইসঙ্গে, তিনি আরেকজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদকে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলের সুবিস্তৃত দুর্নীতি বিষয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রণয়নের দায়িত্ব দিয়েছেন। অর্থনীতিতে এখনো নানা সমস্যা থাকলেও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। উপদেষ্টাদের জন্য এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো মানুষের ভরসা ফিরিয়ে আনা ও বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়াতে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। এটি নিশ্চিত করতে প্রয়োজন কার্যকর অর্থনৈতিক নীতিমালা ও সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন।
স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিষয়ভিত্তিক সংস্কার, চিকিৎসাসেবার গুণগত মানোন্নয়ন, স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঠামো শক্তিশালীকরণে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন; সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ প্রদান এবং প্রধান উপদেষ্টা কর্তৃক সরকার পরিচালনায় ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিতে গণমাধ্যমকে সোচ্চার থাকার আহ্বান জানানো; দ্রুততম সময়ের মধ্যে মেট্রোরেল চালু, শুক্রবারও মেট্রোরেল চালু রাখার সিদ্ধান্ত; মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে বাংলাদেশি কিশোরী স্বর্ণা দাশ নিহত হওয়ার ঘটনায় ভারতের কাছে তীব্র প্রতিবাদ জানানো ও দীর্ঘদিন ধরে অমীমাংসিত তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তিসহ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আন্তঃসীমান্ত নদীর পানিবণ্টন বিষয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনার তাগিদ দেয়া হয়েছে।
সরকারের এক মাসের কার্যক্রম সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত স্বৈরাচার সরকারকে হটিয়ে যে অন্তর্বর্তী সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছে ছাত্র-জনতা স্বাভাবিকভাবেই তার প্রতি প্রত্যাশা বেশি। আমরা চাই দুর্নীতিমুক্ত সমাজ, সিন্ডিকেটমুক্ত বাজার এবং বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র। গত এক মাসে তার কিছু বাস্তবায়নের দিশা দেখা যাচ্ছে, কিছু চ্যালেঞ্জও রয়ে গেছে।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় জানায়, জাতীয় ইস্যুর পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যুও দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিতে হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারকে। দায়িত্ব গ্রহণের পর আন্তর্জাতিক ইস্যুগুলোর সমাধানে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারপ্রধানের পাশাপাশি কূটনীতিকদের সঙ্গে আলোচনা কার্যক্রম চলমান রেখেছে সরকার।