ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

অর্থনৈতিক সহায়তায় জোর দেবে যুক্তরাষ্ট্র

অর্থনৈতিক সহায়তায় জোর দেবে যুক্তরাষ্ট্র

বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথমবারের মতো তিন দিনের সফরে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল ঢাকায় এসেছেন। আজ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলটি। ওই বৈঠকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের চাহিদায় সহযোগিতা জোর দেবে যুক্তরাষ্ট্র। আগামী ১৬ সেপ্টেম্বর মার্কিন প্রতিনিধিদলটি ঢাকা ত্যাগ করবে।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেই বাংলাদেশে কয়েকবার সফর করেছিলেন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। তার ওই সফরগুলোকে কেন্দ্র করে বড় দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষপর্যায়ের নেতারা উত্তপ্ত বক্তব্য দিয়েছিলেন। তবে ডোনাল্ড লু’র এবারের সফরটি একটু ভিন্নমাত্রা যোগ হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতন হয়। আর শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর মার্কিন অর্থ দপ্তরের সহকারী আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যানের নেতৃত্বে মার্কিন একটি শক্তিশালী প্রতিনিধিদল ঢাকা এসেছেন। এ দলে থাকা ডোনাল্ড লু দিল্লির বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় ইস্যুর পাশাপাশি বাংলাদেশ সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন। ঢাকা ও দিল্লির কূটনৈতিক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

গতকাল শনিবার সাড়ে ৩টার দিকে ডোনাল্ড লু’র বহনকারী বিমানটি দিল্লি থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এর আগে সকালে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ দপ্তরের সহকারী আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যান ঢাকায় পৌঁছেন। তিনি সফরকারী প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। প্রতিনিধিদলে নেইম্যান-লু ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ, ইউএসএআইডি এবং মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি কার্যালয়ের প্রতিনিধিরা আছেন।

আজকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দীন আহমেদ ও পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিনের সঙ্গে মার্কিন প্রতিনিধিদের বৈঠক হবে। এ দিন দুপুরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলটির সদস্যরা পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে মধ্যহ্নভোজে অংশ নেবেন। বিকালে প্রতিনিধি দলের নেতা যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব দফতরের ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে বৈঠক করবেন। ওই বৈঠকে বাংলাদেশের বর্তমান সংকট উত্তরণের চাহিদাগুলো জানতে চাইবে ওয়াশিংটন। একইসঙ্গে বিষয়গুলোতে সামনের দিনে কীভাবে সহযোগিতা করা যায়, তা নিয়েও আলোচনা করবে দুই পক্ষ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই দেশের আর্থিক সহযোগিতাসহ সার্বিক প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে সাজানো হয়েছে প্রতিনিধি দল। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর এটি হবে ওয়াশিংটন থেকে উচ্চপর্যায়ের কোনো প্রতিনিধিদলের প্রথম বাংলাদেশ সফর।

মার্কিন প্রতিনিধিদলের সফর প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল ঢাকায় এসেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে যুক্তরাষ্ট্র যে গুরুত্ব দেয়, এটি তার একটি বড় প্রতিফলন। আমাদের সঙ্গে তাদের আলোচনাটা বহুমাত্রিক হবে। এটা শুধু একটি বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।

মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নের চাহিদা মেটাতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাসহ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে জোর দেবে।

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-নতার আন্দোলনে ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে গুরুত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ যেন ঘুরে দাঁড়ায়, তাই বাংলাদেশের বর্তমান সংকট উত্তরণের চাহিদাগুলো সামনে রেখে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনা হবে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান সংকট মোকাবিলায় সহযোগিতার বিষয়গুলো বৈঠকে প্রাধান্য পাবে। তাৎক্ষণিক সহযোগিতার পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদে সহযোগিতার বিষয়গুলো আলোচনায় উঠে আসবে।

অন্যদিকে মার্কিন কূটনৈতিক সূত্র বলছে, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও শ্রম অধিকারের মতো বিষয়গুলো উপেক্ষিত ছিল। যেহেতু শেখ হাসিনার সরকার ভারতের কথা শুনত, তাই এ চ্যালেঞ্জগুলো উত্তরণে ওয়াশিংটন একাধিকবার দিল্লির সঙ্গে আলোচনা করেছে। তবে ভারত বরাবরই নিরাপত্তার অজুহাতে বিষয়গুলোকে এড়িয়ে গেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে ডোনাল্ড লুর সফর নিয়ে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের চাহিদায় সহযোগিতা করতে পারে।

বাংলাদেশের রাজস্ব ও মুদ্রানীতি নিয়ে মার্কিন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনা হবে। একইসঙ্গে আলোচনা হবে স্বাস্থ্য ও আর্থিক ব্যবস্থা নিয়েও। সরকারের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি মার্কিন প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বৈঠক করবে।

যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক অর্থায়নবিষয়ক সহকারী আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যান ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেন, প্রয়োজনীয় সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক দুর্বলতা মোকাবিলা করে প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখা ও ভবিষ্যতে অধিকতর সমৃদ্ধির ভিত্তি তৈরি করতে পারবে বলে যুক্তরাষ্ট্র আশাবাদী। ব্রেন্ট নেইম্যান আরো বলেন, আইএমএফ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সম্পৃক্ততা, যুক্তরাষ্ট্র তাতে সমর্থন দেবে। আর্থিক খাতের গভীর সংস্কার, দুর্নীতি হ্রাস ও টেকসই রাজস্ব ব্যবস্থার উন্নয়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে চায়, তার প্রতিও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন থাকবে।

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের আগে ও পরে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়, তার জেরে অর্থনীতি হোঁচট খাচ্ছে। দেশের অর্থনীতির প্রাণ তৈরি পোশাক খাতের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এই খাতের কর্তাব্যক্তিরা গত মাসে ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেছিলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদেশি ক্রেতারা পোশাক তৈরির কিছু কাজ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশে সরিয়ে নিচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছে। বিশেষ করে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন যেন অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা না হয়, সে কথা বলেছে যুক্তরাষ্ট্র। ড. ইউনূস ও শ্রম সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত আরো ক্রয়াদেশ পেতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব ও অর্থ দফতরের আন্তর্জাতিক অর্থায়নবিষয়ক সহকারী আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যানের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের প্রতিনিধিদলে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের সহকারী মন্ত্রী ডোনাল্ড লু ছাড়াও রয়েছেন দেশটির আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার (ইউএসএআইডি) উপসহকারী প্রশাসক অঞ্জলী কাউর ও সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রেন্ডন লিঞ্চ। গতকাল শনিবার তারা একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। আজকে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে অত্যন্ত ইতিবাচক পরিবেশে মার্কিন দলের বৈঠক হবে বলে আশা করছেন সরকারের কর্মকর্তারা।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কয়েকটি ক্ষেত্রে মার্কিন অর্থ দফতরের বিশেষায়িত জ্ঞান রয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংকিং খাত সংস্কার, মুদ্রা ব্যবস্থাপনা, আর্থিক খাতে নজরদারির মতো বিষয় রয়েছে। বাংলাদেশের চাহিদা অনুযায়ী তারা সহায়তা দিতে প্রস্তুত। সূত্র আরো জানায়, বাংলাদেশকে যে কোনো ধরনের কারিগরি সহায়তা ও বিশেষজ্ঞ জ্ঞান দিতে রাজি আছে যুক্তরাষ্ট্র। এক্ষেত্রে নির্দিষ্টভাবে তাদের কাছে সমস্যাগুলো তুলে ধরা সম্ভব হলে তারা সহায়তা করবে। যেমন, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে অনেক ধরনের সমস্যা রয়েছে। এই সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সহায়তা চাইলে তারা সহায়তা করবে।

সাধারণত অন্য দেশকে ঋণ দেয় না যুক্তরাষ্ট্র। ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে মার্কিন কংগ্রেসের অনুমোদন প্রয়োজন হওয়ার কারণে বিষয়টি অনেক জটিল। তবে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেমন- বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফ থেকে ঋণ পেতে সহায়তা করতে পারে।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলার পাশাপাশি অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনাটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র। তাই আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতার পাশাপাশি পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে সহায়তা করা, বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত করে নতুন বিনিয়োগের পথ সুগম করতে চায় দেশটি।

উল্লেখ্য, সবশেষ গত মে মাসে ঢাকা সফর করেছিলেন ডোনাল্ড লু। তার আগে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন উপলক্ষ্যে গত বছরের শেষ দিকে কয়েকবার বাংলাদেশ সফর করেন তিনি। তখন তার সফর নিয়ে বেশ আলোচনা হয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত