প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মার্কিন প্রতিনিধিদলের বৈঠক

বাংলাদেশ পুনর্গঠনে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চান ড. ইউনূস

বাংলাদেশকে আরো ২০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দেবে যুক্তরাষ্ট্র

প্রকাশ : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে গেছেন। পালানোর আগে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত ১৫ বছরে দেশের অর্থনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা, ব্যাংকিং খাত, বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সব সেক্টর ধ্বংস করে দিয়েছেন। জনগণের মাথাপিছু বিপুল পরিমাণ ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এই পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশের পুনর্গঠন, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার এবং পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চেয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

গতকাল রোববার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় যুক্তরাষ্ট্রের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল সাক্ষাতে এলে ড. ইউনূস এ সহায়তা চান। এ সময় দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। ঘণ্টাব্যাপী এ বৈঠকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও অর্থনৈতিক সংস্কার, বিনিয়োগ, শ্রমিক ইস্যু, রোহিঙ্গা সংকট এবং জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদান উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন নিউইয়র্ক সফর নিয়ে আলোচনা হয়।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো বার্তায় বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, সরকার দ্রুততার সঙ্গে অর্থনীতি পুনর্গঠন ও সংস্কারের কাজ করেছে। আর্থিক খাতে সংস্কার শুরু করেছে এবং বিচার বিভাগ ও পুলিশসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ঠিক করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এটি আমাদের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় এবং আমাদের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে বিপ্লব বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন আশার যুগের সূচনা করেছে।

প্রধান উপদেষ্টা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের একটি রূপরেখা বর্ণনা করেন। গঠিত ছয়টি কমিশনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, দায়িত্ব নেয়ার মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ছয়টি কমিশন গঠন করা হয়েছে, যা ভোটে কারচুপি প্রতিরোধ, বিচার বিভাগ, পুলিশ, প্রশাসন, দেশের দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা সংস্কার এবং সংবিধান সংশোধনের কাজ করছে।

দুর্নীতি মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ বর্ণনা করতে গিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা দুর্নীতির এক বিশাল সমুদ্রে ছিলাম। পূর্ববর্তী স্বৈরশাসনের সঙ্গে যুক্ত দুর্নীতিবাজদের চুরি করা সম্পদ তার সরকার ফিরিয়ে আনতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব ও অর্থ দফতরের আন্তর্জাতিক অর্থায়নবিষয়ক সহকারী আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যানের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল ইউনূসের নেতৃত্বের প্রশংসা করেন এবং তার সংস্কার পরিকল্পনায় ওয়াশিংটন ডিসি সমর্থন করতে পেরে আনন্দিত বলেও জানান। মার্কিন কর্মকর্তারা জানান, তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়ার জন্য প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তা প্রদানে আগ্রহী।

যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধিদলে ছিলেন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু, সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রেন্ডন লিঞ্চ, আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার (ইউএসএআইডি) উপসহকারী প্রশাসক অঞ্জলি কাউর, ট্রেজারি বিভাগের পরিচালক জেরোড ম্যাসন। আলোচনায় অংশ নেন প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, সিনিয়র সচিব এবং এসডিজিবিষয়ক প্রধান লামিয়া মোরশেদ, পররাষ্ট্র সচিব মো. জসিম উদ্দিন এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী।

গতকাল রোববার বেলা ১১টার দিকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে মার্কিন প্রতিনিধিরা সাক্ষাৎ করেন। এসময়ে উন্নয়ন সহযোগিতা চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের উন্নয়নে অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার খাতে বাড়তি ২০০ মিলিয়ন ডলারের সহায়তা দেয়ার আশ্বাস দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

ইউএসএআইডির ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেটর অঞ্জলি কৌর বলেন, বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধিদলের অংশ হতে পেরে ভালো লাগছে। আমরা সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছি। এর আওতায় সরকারের অগ্রাধিকার খাতে ২০০ মিলিয়ন ডলারের সহায়তা দেয়া হবে। আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করতে চাই। আমরা এখন চুক্তি অনুযায়ী কাজ করবো। এ চুক্তি মূলত সরকারের অগ্রাধিকারমূলক কাজগুলো এগিয়ে নেয়ার জন্য।

বৈঠকের পর অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা মার্কিন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলাপ করেছি। আমাদের মূল আলোচনা ছিল তাদের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট ও ইউএসএআইডির সঙ্গে। বিশেষ করে আর্থিক সংস্কার, আর্থিক খাতে যে সহযোগিতা দরকার সেটা। দ্বিতীয়ত বাণিজ্য, আমরা এক্সপোর্ট ডাইভারসিফিকেশন এবং বাণিজ্যে বিভিন্ন কারিগরি সহায়তা বা বাজার এক্সপ্লোর করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগোবো। তারা সে ব্যাপারে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।

উন্নয়ন সহযোগিতা চুক্তির বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, আগে যে চুক্তি হয়েছিল সেটার সঙ্গে আরো ২০০ মিলিয়ন যোগ করা হয়েছে। আগের অর্থের সঙ্গে এটি যুক্ত হয়েছে। তার মানে আরো বাড়তি টাকা তারা দেবে। এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ইউএসএআইডির সঙ্গে ২০০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি সই করেছে বাংলাদেশ। ডেভেলপমেন্ট অবজেক্টিভ গ্রান্ট এগ্রিমেন্ট (ডিওএজি)-এর ষষ্ঠ সংশোধনী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। একেএম শাহাবুদ্দিন, অতিরিক্ত সচিব, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং রিড জে. এশলিম্যান, মিশন পরিচালক, ইউএসএআইডি সংশোধনীতে স্বাক্ষর করেন।

২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১-২৬ সালের জন্য জিওবি এবং ইউএসএআইডির মধ্যে একটি নতুন ডিওএজি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ডিওএজি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইউএসএআইডি মোট ৯৫৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অবদান রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ৫ম সংশোধনী পর্যন্ত ইউএসএআইডি ৪২৫ মিলিয়ন ডলার প্রদান করেছে। এবার ষষ্ঠ সংশোধনীর অধীনে ইউএসএআইডি ২০২ দশমিক ২৫ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেবে।

গতকাল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় মার্কিন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক শেষে পররাষ্ট্র সচিব এম জসীম উদ্দিন বলেন, মার্কিন প্রতিনিধিদল অন্তর্বর্তী সরকারের সংষ্কার পরিকল্পনা সম্পর্কে জানার আগ্রহ ব্যক্ত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ দপ্তরের সহকারী আন্ডারসেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যানের নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করছে। কিছুক্ষণ আগে তাদের সাথে বৈঠক করেছি। বৈঠকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব, রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, বাণিজ্য সচিব, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে দুই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলেছি। ছাত্র-জনতার চরম আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে অর্জিত নতুন বাংলাদেশে সূচিত বৈপ্লবিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সরকার এরইমধ্যে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে সেসব পদক্ষেপ সম্পর্কে আমরা প্রতিনিধিদলকে অবহিত করেছি।

সচিব জানান, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাওয়ার অঙ্গীকার তারা পুনর্ব্যক্ত করেন। সরকারের সংস্কার পরিকল্পনা সম্পর্কে তারা জানার আগ্রহ ব্যক্ত করেন। দ্রুত সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়টি এ সরকারের বিশেষ অগ্রাধিকার বিবেচনায় আর্থিক ও রাজস্ব খাতে সংস্কারের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য সহযোগিতার ক্ষেত্র দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। একই সঙ্গে শ্রম পরিবেশ, মানবাধিকার সুরক্ষা, রোহিঙ্গা মানবিক সহায়তাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেই বাংলাদেশে কয়েকবার সফরে এসেছিলেন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। তার ওই সফরগুলোকে কেন্দ্র করে বড় দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষপর্যায়ের নেতারা উত্তপ্ত বক্তব্য দিয়েছিলেন। তবে ডোনাল্ড লু’র এবারের সফরটি একটু ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণ, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা গড়ে তোলা এবং মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে সহায়তারও আশ্বাস দিয়েছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে গুরুত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ যেন ঘুরে দাঁড়ায়, তাই বাংলাদেশের বর্তমান সংকট উত্তরণের চাহিদাগুলো সামনে রেখে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান সংকট মোকাবিলায় সহযোগিতার বিষয়গুলো বৈঠকে প্রাধান্য পেয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশের একটি বিশ্বস্ত উন্নয়ন অংশীদার। ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত অর্থনৈতিক প্রযুক্তিগত এবং সম্পর্কিত সহায়তা শীর্ষক একটি চুক্তির অধীনে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র এবং শাসনের মতো বিভিন্ন খাতে এখন পর্যন্ত ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি অনুদান দিয়েছে। আজ মার্কিন প্রতিনিধিদল ঢাকা ত্যাগ করবে।