বিএনপির সমাবেশে তারেক রহমান

জনগণকে অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে দাঁড়াতে হবে

প্রকাশ : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আমিরুল ইসলাম অমর

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত সরকার অবশ্যই জনগণের সরকার। তাই জনগণকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পাশে দাঁড়াতে হবে। তবে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করাই এই সরকারের জরুরি কার্যক্রম হওয়া উচিত। তাই জনগণের নির্বাচনে সংসদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান কাজ। সংসদীয় সরকার ছাড়া কোনো সংস্কার স্থায়ী হয় না। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর নয়াপল্টনে বিশ্ব গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশে ভার্চুয়ালি প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। সমাবেশে নয়াপল্টনসহ আশপাশের এলাকায় বিএনপির নেতাকর্মীদের ঢল নামে।

তারেক রহমান বলেন, লাখো শহিদের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের রাষ্ট্র-রাজনীতি শাসন-প্রশাসন হওয়ার কথা ছিল গভর্নমেন্ট অফ দ্য পিপল বাই দ্য পিপল ফর দ্য পিপল। অথচ গত ১৫ বছর বাংলাদেশে মাফিয়া শাসন চালু করা হয়েছিল। দেশে-বিদেশে পলাতক স্বৈরাচার বিনাভোটের সরকারের পরিচয় হয়ে উঠেছিল গভর্নমেন্ট অফ দ্য মাফিয়া বাই দ্য মাফিয়া ফর দ্য মাফিয়া। তিনি বলেন, এই মাফিয়া চক্র দেশকে সর্বক্ষেত্রে ভঙ্গুর করে দিয়েছিল। দেশকে সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর ঋণনির্ভর এবং পরনির্ভরশীল রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। মাফিয়া চক্র দেশের ব্যাংকগুলো দেউলিয়া করে দিয়েছে। গত দেড় দশকে দেশ থেকে ১৭ লাখ কোটি টাকার বেশি পাচার করে দিয়েছে।

বিএনপির এই শীর্ষ নেতা বলেন, বাংলাদেশের বীর ছাত্র-জনতা নারী শিশু কৃষক শ্রমিক সব শ্রেণি-পেশার মানুষ সর্বস্তরের জনগণ বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের জনগণ বন্দুকের সামনে বুক পেতে দিতে রাজি তবুও স্বৈরশাসন মেনে নিতে রাজি নয়। বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষ থেকে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী বীর জনগণকে জানাই আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবসের শুভেচ্ছা।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যারা শহিদি মৃত্যুবরণ করেছেন, যারা আহত হয়েছেন, হাত-পা-চোখ হারিয়েছেন কিংবা চিরতরে পঙ্গুত্ববরণ করেছেন দেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ আজীবন তাদের এই আত্মত্যাগ এবং অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। হতাহতদের প্রতিটি পরিবারের প্রতি অবশ্যই রাষ্ট্র যথাযথ দায়িত্ব পালন করবে। তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পতিত স্বৈরাচারের বেপরোয়া দুর্নীতি আর লুটপাটের কারণে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ বর্তমানে ১০০ বিলিয়ন ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশে আজ যে শিশুটি জন্ম নিয়েছে কোনো কারণ ছাড়াই সেই শিশুটিরও মাথা পিছু ঋণ কমপক্ষে দেড় লাখ টাকা। তারেক রহমান বলেন, হাজারো শহীদের রক্তস্নাত এই রাজপথে আজ আপনাদের এই স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতির অর্থ ছাত্র-জনতার কাঙ্ক্ষিত বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার এই যাত্রাপথে বাংলাদেশের পক্ষের শক্তিকে হয়তো আরো ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। আরো কিছু পথ পাড়ি দিতে হবে। তবে সেই পথ সন্ত্রাস-সংঘর্ষ-প্রতিশোধ কিংবা প্রতিহিংসার নয়। সেই পথ হবে ধৈর্য-সহনশীলতা এবং সমঝোতার।

সরকার ও আমলাদের মধ্যে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের অনেক প্রেতাত্মা অবস্থান করছে বলে মন্তব্য করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তারা চক্রান্ত করছে। এই চক্রান্তকে রুখে দাঁড়াতে হবে। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হবে। তিনি বলেন, শুধু ৫২ কিংবা ’৭১ নয়, সেই ব্রিটিশ আমল থেকে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই-সংগ্রাম চলছে। শেখ হাসিনা গত ১৫ বছর বাংলাদেশের মানুষের ওপর স্টিম রোলার চালিয়ে গেছে, সেটাকে উপেক্ষা করে আজ আমরা একটা মুক্ত পরিবেশে এসেছি।

গণতন্ত্র আর বিএনপি সমার্থক উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান এক দলীয় শাসন থেকে বহুদলীয় শাসন চালু করেছেন। আর দেশনেত্রী খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতি শাসন থেকে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু করেছেন।

সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করেছেন বলে দাবি করে মির্জা ফখরুল বলেন, ২০১৬ সালে খালেদা জিয়া ভিশন ২০২১ দিয়ে গণতন্ত্র টেকসই করার কথা বলেছেন। আর ২০২৩ সালে বিএনপি আবার ৩১ দফা দিয়েছে।

গত ১৬ বছরে বিএনপির অনেক নেতাকর্মী প্রাণ দিয়েছে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, অনেকে কারাগারে গিয়েছেন। অনেকে গ্রামে না থাকতে পেরে ঢাকায় এসে রিকশা চালিয়েছে। গতকাল আমি পঙ্গু হাসপাতালে গিয়ে দেখেছি, ১৩ বছরের একটি ছেলের গুলি লেগে পা হারিয়েছে। এইভাবে গণতন্ত্র-মুক্তির সংগ্রাম চলছে। সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, ছাত্র-জনতার ত্যাগের মাধ্যমে আমরা সুযোগ পেয়েছি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা করার। সেই সুযোগ যেন আমরা হেলায় না হারাই। আজ এমন একটা অবস্থা তৈরি করতে হবে যাতে সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারি।

সমাবেশে উপস্থিত তরুণ নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে মির্জা ফখরুল বলেন, আপনারা হচ্ছেন সেই ভ্যানগার্ড, আজ আবার কেউ গণতন্ত্রকে বিপথে নিতে চাইলে রুখে দাঁড়াবেন। তারেক রহমান দেশে ফিরে আসবেন। দেশনেত্রী খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাবেন এবং ফিরে আসবেন।

গণঅভ্যুত্থানে আহত-নিহতদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবিও জানান মির্জা ফখরুল। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্দেশ্যে বলেছেন, আপনারা নানা সংস্কারের কথা বলছেন। কিন্তু সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অনুরোধ করতে চাই, অবিলম্বে ভোটের ব্যবস্থা করতে হবে। জনগণ ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি সংসদে পাঠাবে।

ড. খন্দকার মোশাররফ বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন হয়েছে। কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু জনগণের এখনও অধিকারের পুরোপুরি ফেরত দেয়া হয়নি, জনগণের ভোটের অধিকার ফেরত দেয়া হয়নি। আমরা সেটা দিতে চাই।

বিএনপির এই নেতা বলেন, এত বড় একটি পরিবর্তনের পর স্বৈরাচার সরকার যেসব অন্যায়, অত্যাচার, দুর্নীতি করেছে তার বিচার অবিলম্বে চাই। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন সব সেক্টর ধ্বংস করে গেছে শেখ হাসিনা। অনতিবিলম্বে সব সেক্টরে সংস্কার করতে হবে; যাতে মানুষ নিরাপদে থাকতে পারে, নিজের ভোট দিতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।

নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, বিএনপি ১৬ বছর আন্দোলন করে এখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে। আমাদের সাবধান সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের বিজয় এখনও হয়নি। বিজয় ছিনিয়ে নিতে হবে।

বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেছেন, ছাত্র-জনতার জনস্রোতে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ভেসে গেছেন। এ ক্ষেত্রে তারেক রহমানের সুযোগ্য নেতৃত্বে দেশ স্বৈরাচারমুক্ত হয়েছে। বিএনপির এই নেতা বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা যে ইতিহাস তৈরি করেছে; তা পুরো পৃথিবীর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ছাত্র-জনতার জনস্রোতে স্বৈরাচার হাসিনা ভেসে গেছেন। ছাত্র-জনতাকে বিএনপি সমর্থন দিয়েছে ও দেবে। তবে নির্ধারিত সময়ে প্রথম ম্যান্ডেট নির্বাচন দিতে হবে। একই সঙ্গে গত ১৫ বছরে যে জুলুম নির্যাতন করা হয়েছে, তার বিচার করতে হবে।

বাংলাদেশে শান্তি বিনষ্ট হলে দিল্লিকেও শান্তিতে থাকতে দেয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল। তিনি বলেন, হত্যাকারী শেখ হাসিনাকে ভারত আশ্রয় দিয়েছে। তারা নানা ষড়যন্ত্র করছেন। বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ একেকজন সৈনিক। অতএব হুমকি দিয়ে কাজ হবে না।

হাবিব উন নবী খান সোহেল বলেন, আমরা শেখ হাসিনাকে বহুবার বলেছি কেয়ারটেকার সরকার দেন। আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বহুবার বলেছেন। কিন্তু তিনি আমাদের কথা শোনেননি। তিনি দাদাদের কথা শুনলেন। আমাদের কথা শুনলে এভাবে পালিয়ে যেতে হতো না। এখন বলেন তিনি নাকি চট করে ঢুকে যাবেন? তিনি বলেন, ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন শেখ হাসিনা পালায় না, মুজিবকন্যা পালায় না। কোথায় কাদের? দলের সব নেতাকর্মীকে ফেলে পালালেন। যেন চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। শেখ হাসিনা এই দৌড় অলিম্পিকে দিলে সোনার মেডেল পেতেন। গত ১৫ বছরে বিএনপির শত শত নেতাকর্মীকে হত্যা ও গুম করা হয়েছে। শত শত ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়েছে। পিলখানায় ৫৭ জন সেনা অফিসারকে হত্যা করা হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে বিএনপি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে উল্লেখ করে দলটির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি বলেছেন, প্রশাসনে ফ্যাসিবাদের যত প্রেতাত্মা আছে, তাদের চিহ্নিত করতে হবে। তিনি বলেন, জনগণের টাকা লুটপাট করেছে সব টাকা ফেরত আনতে হবে। আমাদের দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম ছিল নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে। জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। এটা আমাদের দাবি, জনতার দাবি। শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি বলেন, গণতন্ত্রের সংগ্রামে দীর্ঘদিন লড়াই-সংগ্রাম করে অসুস্থ হয়ে এখন চিকিৎসাধীন আছেন দেশনেত্রী খালেদা জিয়া। আমরা তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। আমাদের নেতা তারেক রহমানের মামলা আইনি প্রক্রিয়ায় প্রত্যাহার করতে হবে। তিনি আমাদের মাঝে দ্রুত ফিরে আসবেন এই প্রত্যাশা করছি।

সমাবেশে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম মজনু বলেন, এক মাসের আন্দোলন নয়, বরং ১৬ বছরের গুম খুন নির্যাতনের শেষ পরিণতি শেখ হাসিনার পতন। এখনো খুনি শেখ হাসিনার প্রেতাত্মা দালালরা ষড়যন্ত্র করছেন। তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। তারেক রহমানের নেতৃত্বে ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করে গণতন্ত্র সুসংহত করতে হবে।

সমাবেশে যুবদলের সভাপতি মোনায়েম মুন্না বলেন, শেখ মুজিব পঁচাত্তরে একদলীয় বাকশাল গঠন করেছিলেন। সেখান থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জিয়াউর রহমান। পরে ১৯৯১ সালে স্বৈরাচার এরশাদের পতন ঘটিয়ে আবারো গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেন খালেদা জিয়া। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে আবারো একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করার চেষ্টা চালায়। তিনি বলেন, আমাদের আন্দোলন এখনো শেষ হয়ে যায়নি। তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে আরো বক্তব্য রাখেন- দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, আব্দুস সালাম আজাদ প্রমুখ। আরো বক্তব্য দেন- চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী সাইয়েদুল আলম বাবুল, মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাস, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান, কৃষক দলের সভাপতি হাসান জাফির তুহিন প্রমুখ। সমাবেশে সঞ্চালনা করেন- বিএনপির প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ও ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ সদস্য সচিব আমিনুল হক, তানভীর আহমেদ রবিন।