ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ঢাবি ও জাবিতে দুইজনকে পিটিয়ে হত্যা

দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড়!

দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড়!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে তোফাজ্জল নামের এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। অপরদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) সাবেক শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লাও শিক্ষার্থীদের গণধোলাইয়ে নিহন হন। আলোচিত এই দুই ঘটনায় দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় সৃষ্টি হয়েছে। জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে তোফাজ্জল নামের এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। গত বুধবার রাত পৌনে ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত হলে এ ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে গতকাল দুপুরে রাজধানীর শাহবাগ থানায় মামলা দায়ের করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। মামলার পরপরই চারজনকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষে এস্টেট অফিসের সুপারভাইজার মোহাম্মদ আমানুল্লাহ শাহবাগ থানায় এজাহার দায়ের করেন।

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ‘গত ১৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ মিনিটের দিকে একজন যুবক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের গেটে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করতে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু ছাত্র তাকে আটক করে প্রথমে ফজলুল হক মুসলিম হলের মূল ভবনের গেস্টরুমে নিয়ে সে মোবাইল চুরি করেছে বলে এলোপাতাড়ি চর থাপ্পড় ও কিলঘুষি মারে। এ সময় তাকে জিজ্ঞাসা করলে তার নামণ্ডতোফাজ্জল বলে জানায়।’ এজাহারে আরো উল্লেখ করা হয়, ‘পরবর্তীতে সে মানসিক রোগী বুঝতে পেরে তাকে ফজলুল হক মুসলিম হলের ক্যান্টিনে নিয়ে খাবার খাইয়ে তাকে ফজলুল হক মুসলিম হলের দক্ষিণ ভবনে গেস্ট রুমে নিয়ে জানালার সঙ্গে পিছনে হাত বেঁধে স্ট্যাম্প, হকিস্টিক ও লাঠিদ্বারা উচ্ছৃঙ্খল কিছু ছাত্র বেধড়ক মারধর করলে সে অচেতন হয়ে পড়ে। পরে বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন আবাসিক শিক্ষককে জানালে তাদের সহায়তায় অচেতন যুবককে মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে উক্ত যুবককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে ডাক্তার প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বুধবার দিবাগত রাত ১২টা ৪৫ মিনিটের সময় তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।’ ঘটনার পরদিন গতকাল বিকালে এই হত্যায় জড়িত জালাল আহমেদ, সুমন ও মুস্তাকিন সাকিন ও সাজ্জাদকে আটক করে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এদের মধ্যে জালাল ছাত্রলীগের উপ-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতি ছেড়ে দেন। জালাল পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৮-১৯ এবং সুমন মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। বাকি দুইজনের বিস্তারিত পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি। প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য : ঘটনার একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বুধবার হলের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট ও ফুটবল টুর্নামেন্টের খেলা চলছিল। দুপুরের দিকে হলের ৬ জন শিক্ষার্থীর মোবাইল ফোন চুরি হয়ে যায়। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে তোফাজ্জল নামের ওই ব্যক্তি হলে আসলে তাকে ফোন চুরি করার সন্দেহে আটক করে শিক্ষার্থীরা। এরপর রাত ৭টা ৪৭ থেকে ৪৮ মিনিটের দিকে তাকে হলের প্রধান ভবনের অতিথি কক্ষে নিয়ে আসা হয়। সিসিটিভি ফুটেজ থেকে প্রধান ভবনের অতিথি কক্ষে নিয়ে আসার সময় নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে। এরপর সেখানে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি ফোন চুরির বিষয় অস্বীকার করেন। তখন তাকে এক দফা পেটানো হয়। তবে সেগুলো চড় থাপ্পড় এমন ধরনের। এরপর তাকে হলের ক্যান্টিনে খাবার খেতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে ডাল ও মাংস দিয়ে ভাত খাওয়ানো হয়। এরপর তাকে হলের বর্ধিত ভবনের অতিথি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে কয়েক দফা পেটানো হয়। তখন স্ট্যাম্প ও লাঠি দিয়ে তাকে পেটানো হয়। এক পর্যায়ে তাকে আবারো হলের প্রধান ভবনের অতিথি কক্ষে নিয়ে আসা হয়। সেখানেও তাকে পেটানো হয়। রাত ১০টা ৫২ মিনিটে তাকে সেখান থেকে বের করে প্রক্টরিয়াল টিমের গাড়িতে তোলা হয়। সিসিটিভি ফুটেজ থেকে বের করার সময়টিও নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে। ফুটেজে দেখা যায় এসময় তিনি দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে গাড়িতে উঠছেন। তার শরীরে ছোট হাফ প্যান্ট ছাড়া অন্য কোনো কাপড় ছিলো না। সেখান থেকে তাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। থানায় ১৫ থেকে ২০ মিনিট অবস্থানের পর তার অবস্থা আশঙ্কাজনক হলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে রাত ১২টা ৪৫ মিনিটে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সময়টি নিশ্চিত করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক ড. সাইফুদ্দিন আহমেদ।

বিভিন্ন সংগঠনের নিন্দা : এ ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সংবাদ সম্মেলন করেছে বিএনপির অঙ্গসংগঠন ছাত্রদল। এছাড়াও, বাম ছাত্র সংগঠনগুলো এর প্রতিবাদে গতকাল বিক্ষোভ মিছিল করে। জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উপস্থিতিতে পুরোনো ফ্যাসিবাদি কায়দায় নির্যাতন করে প্রক্টরিয়াল বডির কাছে হস্তান্তর এবং পরবর্তীতে থানায় প্রেরণ করার ঘটনা ঘটেছে। উপরোক্ত দুই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডি কোনোভাবে দায় এড়াতে পারে না। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে ফ্যাসিবাদি কায়দায় এ ধরনের হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। জাতীয় নাগরিক কমিটি মনে করে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও ‘মব-ভায়োলেন্সে’র মতো সব ফ্যাসিবাদি ব্যবস্থা ও উপাদানের শিগগিরই বিলোপ করতে হবে এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সূচনা করতে হবে। আমরা মনে করি, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয় এবং সব অপরাধের বিচারের দায়িত্ব আদালতের। যারা আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে তারা অপরাধ করছে এবং দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলছে বলে আমরা মনে করি।

এদিকে, গণপিটুনির শিকার হওয়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) সাবেক শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লা সাভারের গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। গত বুধবার দিবাগত রাতে সাভারের গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর সেখানে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন আশুলিয়া থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কামাল হোসেন। গণস্বাস্থ্য মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. সেলিমুজ্জামান সেলিম বলেন, আমাদের এখানে তাকে নিয়ে আসার পর আমরা পরীক্ষা করে দেখি যে তিনি মৃত। অর্থাৎ তাকে আমাদের এখানে মৃত অবস্থায় আনা হয়। তার শরীরে সেরকম গুরুতর কোনো ক্ষত পাওয়া যায়নি। এছাড়াও তার মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটনে ময়নাতদন্তের প্রয়োজন রয়েছে বলেও জানান তিনি।

প্রত্যক্ষদর্শী ও নিরাপত্তা কর্মকর্তা সূত্রে জানা যায়, গত বুধবার বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তিক সংলগ্ন একটি দোকানে অবস্থান করছিলেন শামীম। খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী সেখানে গিয়ে তাকে আটক করে গণধোলাই দেন। পরে খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম সেখানে উপস্থিত হয়। এক পর্যায়ে নিরাপত্তা কর্মীদের সহায়তায় তাকে নিরাপত্তা অফিসে নিয়ে আসা হয়। এরপর প্রক্টরিয়াল টিমের খবরে আশুলিয়া থানা পুলিশের একটি দল নিরাপত্তা শাখায় আসে। এরপর তাকে ১৫ জুলাইয়ে হামলার ঘটনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদের পর পুলিশে সোপর্দ করা হয়। এর আগে গত ১৫ জুলাই রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে শাখা ছাত্রলীগের সাবেক এই নেতাকে মারধর করা হয়। বুধবার বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তিক গেট সংলগ্ন এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। পরে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির হাতে তুলে দেয়া হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, শামীম মোল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের এলাকায় থাকেন। আশপাশের এলাকায় মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ, জমি দখল, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলাসহ আশুলিয়া থানায় চারটি মামলা রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন আশুলিয়া থানা পুলিশ। গত ১৫ জুলাই রাতে উপাচার্যের বাসভবনে অবস্থানরত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ ও বহিরাগত সন্ত্রাসী কর্তৃক হামলার ঘটনায় প্রথম সারিতে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহীন বলেন, বিকালে খবর পেয়ে নিরাপত্তা শাখার কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যায়। সেখানে ৩৯ ব্যাচের সাবেক ছাত্রকে উদ্ধার করে প্রক্টর অফিসে নিয়ে আসা হয়। পরে তার সাথে কথা বলে ওই ছাত্রের বিরুদ্ধে আগে থাকা মামলায় তাকে আশুলিয়া থানা পুলিশে সোপর্দ করা হয়।

এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. একেএম রাশিদুল আলম বলেন, প্রক্টর অফিসে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় তাকে আশঙ্কাজনক মনে হয়নি। এমনকি তিনি নিজে হেঁটে পুলিশের গাড়িতে উঠেছেন। এরকম আসামিকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার পথে মৃত্যুবরণ করার বিষয়টি রহস্যজনক। নিশ্চিত না হয়ে এ বিষয়ে মন্তব্য করা উচিত বলে মনে করছি না।

বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ : এদিকে গণধোলাইয়ের জের ধরে এই বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনায় গত বুধবার রাত থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার দিনব্যাপী কয়েক দফায় বিক্ষোভ কর্মসূচি করেছে শিক্ষার্থীরা। বুধবার দিবাগত রাত ২টায় ঘটনার প্রতিবাদে ও সুষ্ঠু তদন্তের ভিত্তিতে বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় শুরু হয়ে কয়েকটি সড়ক প্রদক্ষিণ করে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে গিয়ে শেষ হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সংলগ্ন সড়কে বিক্ষোভ কর্মসূচি ও বিকাল ৪টায় মানববন্ধন করেন। তাদের বিক্ষোভ শেষে তাদের মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসনিক ভবনে গিয়ে শেষ হয়। প্রত্যেক কর্মসূচিতেই শিক্ষার্থীরা দ্রুততম সময়ে জড়িতদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার জোর দাবি জানান।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত