সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান ড. ইউনূসের

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে সরকার

খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি পরিস্থিতি : খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সংঘর্ষে নিহত ৪ * দুই পার্বত্য জেলায় ১৪৪ ধারা জারি * আজ যাচ্ছে উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল

প্রকাশ : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি প্রতিনিধি

খাগড়াছড়িতে দুই পক্ষের সংঘর্ষে তিনজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তারা হলেন, ধনঞ্জয় চাকমা (৫০), রুবেল ত্রিপুরা (২৫) ও জুনান চাকমা (২০)। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো বেশ কয়েকজন। গত বৃহস্পতিবার রাতে খাগড়াছড়ি আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়। নিহতের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রাম রেঞ্জ পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আহসান হাবিব পলাশ।

জানা গেছে, দুই পক্ষের সংঘর্ষে দীঘিনালায় ধনঞ্জয় ত্রিপুরা এবং খাগড়াছড়ি সদরে রুবেল ত্রিপুরা ও জুনান ত্রিপুরা আহত হন। পরে তাদের খাগড়াছড়ি আধুনিক সদর হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে ধনঞ্জয় ত্রিপুরা এবং রাত দেড়টার দিকে রুবেল ত্রিপুরা ও জুনান ত্রিপুরা মারা যান।

খাগড়াছড়ি আধুনিক সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) রিপল বাপ্পী চাকমা বলেন, দীঘিনালা ও সদর উপজেলা থেকে আসা নয়জন বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এর বাইরে উন্নত চিকিৎসার জন্য চারজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এর আগে বৃহস্পতিবার বিকেলে খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় সংঘর্ষ থেকে স্থানীয় বাজারে অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় পুড়ে ছাই হয়ে যায় অর্ধশতাধিক দোকানপাট ও বসতবাড়ি।

খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মো. আরিফিন জুয়েল বলেন, দীঘিনালায় বৃহস্পতিবার বিকেলের দিকে মামুন নামে এক যুবক হত্যার প্রতিবাদে কলেজ শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিলকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। এ সময় দুপক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে এবং দোকানপাট ও বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এদিকে খাগড়াছড়ির সহিংসতার উত্তাপ ছড়িয়েছে পাশের জেলা রাঙামাটিতেও। এতে একজনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া এই সংঘাতে অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৪৪ ধারা জারি করেছে জেলা প্রশাসন। রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক সাদিয়া আক্তার জানান, সংঘাতে অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৬ থেকে ৭ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এ ছাড়া একজন মারা গেছেন। তবে তার নামণ্ডপরিচয় এখনো জানা যায়নি।

শহরের জিমনেসিয়াম চত্বর থেকে কয়েক হাজার পাহাড়ির একটি মিছিলে ইটপাটকেল নিক্ষেপের অভিযোগ তুলে বাঙালিদের বেশ কিছু দোকানপাটে হামলা চালানো হয়। গতকাল শুক্রবার সকালের দিকে এ ঘটনা ঘটে। রাস্তায় চলাচলকারী বাস, ট্রাক, ট্যাক্সিতেও হামলা করা হয়। শহরের হ্যাপির মোড়কে কেন্দ্র করে এর দুদিকে অবস্থান নেন পাহাড়ি ও বাঙালিরা।

এদিকে গতকাল শুক্রবার বেলা দেড়টা থেকে রাঙামাটি পৌর এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে প্রশাসন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জেলা প্রশাসক মো. মোশাররফ হোসেন খান।

এছাড়া উদ্ভূত পরিস্থিতিতে খাগড়াছড়িতেও ১৪৪ ধারা জারি করেছে জেলা প্রশাসন। খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. সহিদুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে খাগড়াছড়িতে গতকাল শুক্রবার দুপুর ২টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।

রাঙামাটি পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. জামালউদ্দিন জানিয়েছেন, সকালে পাহাড়িদের একটি মিছিল বনরূপায় এসে ফিরে যাওয়ার সময় বাঙালিদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলাসহ বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে। এরপরই বাঙালি ব্যবসায়ীরা সংঘবদ্ধ হয়ে তাদের পাল্টা ধাওয়া দেয়।

পুলিশ জানিয়েছে, রাঙামাটিতে গতকাল সকালে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হয়। শহরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য পুলিশ, সেনাবাহিনী ও বিজিবি কাজ শুরু করেছে।

এদিকে আগুনে ফাইবার অপটিকের ক্যাবল পুড়ে যাওয়ায় শহরে ইন্টারনেটসেবা ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ইয়েস নেটের পরিচালক মো. শাহীন।

খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালায় পাহাড়ি ও বাঙালির সংঘর্ষের জের ধরে বৃহস্পতিবার রাতভর জেলা সদরে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এতে তিনজন নিহত হন। এ ছাড়া আহত হয়েছেন আরও ৯ জন। এদের মধ্যে চারজনের অবস্থা গুরুতর। তাদের চট্টগ্রামে পাঠানো হয়েছে।

চট্টগ্রাম রেঞ্জ পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আহসান হাবিব এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার রাতে (আনুমানিক সাড়ে ১০টা) জেলা শহরের নারানখাইয়া, স্বনির্ভর এলাকায় ব্যাপক গুলির শব্দ শোনা যায়। এ সময় পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তবে কাদের মধ্যে এ গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে, তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেনি।

পাহাড়ে সংযমের আহ্বান সরকারের : খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সংঘাত, সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনায় গভীর দুঃখ প্রকাশ করে সকল বাহিনীকে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শন এবং পার্বত্য তিন জেলার সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

সমস্যা নিরসনে সরকার ‘আন্তরিকভাবে কাজ করে’ যাচ্ছে এবং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার নেতৃত্বে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল শনিবার খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি পরিদর্শনে যাবে বলে সরকারপ্রধানের দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে। গত শুক্রবার প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, “খাগড়াছড়ি ও আজ রাঙামাটিতে সৃষ্ট সমস্যা নিরসনে আন্তরিকভাবে কাজ করছে সরকার। ১৮ সেপ্টেম্বর জনৈক ব্যক্তিকে গণপিটুনি ও পরবর্তীতে তার মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে চলমান হামলা, আক্রমণ ও প্রাণহানির ঘটনায় সরকার গভীরভাবে দুঃখিত এবং ব্যথিত। সরকারের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সকল বাহিনীকে সর্বোচ্চ সংযম দেখাতে এবং পার্বত্য তিন জেলায় বসবাসকারী সকল জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সেখানে শান্তি, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি নিশ্চিতকরণে সরকার বদ্ধপরিকর। আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়ার এবং ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর বলেছে, ‘আইন নিজ হাতে তুলে নেয়া এবং যে কোনো সম্পত্তি ধ্বংস করা দণ্ডনীয় ও গর্হিত অপরাধ। সহিংসতার সাথে সম্পর্কিত সকল ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত আর দায়ী ব্যক্তিদের বিচার নিশ্চিত করা হবে। এ লক্ষ্যে একটি শক্তিশালী তদন্ত কমিটি খুব শিগগিরই গঠন করা হবে। আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের যে প্রতিনিধি দল আজ শনিবার খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে যাবে, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা হাসান আরিফ এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সংহতি উন্নয়নবিষয়ক বিশেষ সহকারী অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল আব্দুল হাফিজ থাকবেন সেই দলে।