ড. বদিউল আলম মজুমদারের সাক্ষাৎকার

ইসি নিয়োগ আইন ত্রুটিপূর্ণ ইভিএমে ভোট নয়

ড. বদিউল আলম মজুমদার। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। একাধারে তিনি রাজনীতি বিশ্লেষক, স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তাকে। এই প্রেক্ষাপটে নির্বাচনব্যবস্থা কীভাবে সংস্কার করা সম্ভাব সেই সম্পর্কে কথা বলেছেন দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশের সঙ্গে- সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক আলম।

প্রকাশ : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আলোকিত বাংলাদেশ : অতীতের নির্বাচন ব্যবস্থার ত্রুটি সংক্রান্ত বহু আলোচনা করেছিলেন। এবার আপনিই নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধানের দায়িত্ব পেলেন। জাতীয় থেকে স্থানীয় পর্যায়ে পুরো নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কিভাবে করবেন?

বদিউল আলম মজুমদার : নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের কমিশনের দায়িত্ব পাওয়ায় সম্মানিতবোধ করছি, এটা আমাদের বহুদিনের কাজের স্বীকৃতিও বটে, এটাকে আমি অপূর্ব সুযোগ বলে মনে করছি। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার নিয়ে সোচ্চার ছিলাম। আগামী নির্বাচন নিয়ে সুস্পষ্টভাবে কিছু তুলে ধরতে পারব, যা সরকার বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে পারে। যার মাধ্যমে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথ সুগম হবে। এই আশাবাদ আমার মধ্যে রয়েছে।

আলোকিত বাংলাদেশ : নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২ কীভাবে দেখছেন?

বদিউল আলম মজুমদার : নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২ ত্রুটিপূর্ণ, এটা গ্রহণযোগ্য আইন নয়। এই আইনের মাধ্যমে সরকার ইচ্ছা করলেই যেকোনো ব্যক্তিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনার পদে নিয়োগ দিতে পারে। এই আইনে প্রথমত, পেশাজীবী সংগঠনকে নাম প্রস্তাবের জন্য নির্ধারণ করা হলেও প্রজ্ঞাপনে তা বাদ দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, আইনে না থাকলেও প্রজ্ঞাপনে ব্যক্তিকে নাম প্রস্তাবের অনুমতি দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ সংসদে পাস করা আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে আউয়াল কমিশনারকে নিয়োগ দেয়া হয়। অথচ নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইনে বলা আছে- রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠন নির্বাচন কমিশনারের নাম প্রস্তাব করতে পারবে। কিন্তু সাবেক প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান সেই আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ উন্মুক্ত করে দেন। এতে যেকোন ব্যক্তি যেকোন ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করতে পারবেন, প্রয়োজনে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিজের নামও নিজে প্রস্তাব করতে পারবেন। যা আইনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়, আইনে সুস্পষ্ট বলা আছে- রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠন নির্বাচন কমিশনারের নাম প্রস্তাব করতে পারবে, সেখানে নিয়োগ হবে স্বচ্ছতারভিত্তিতে। কিন্তু আউয়াল কমিশনার নিয়োগে কোন ধরনের স্বচ্ছতা হয়নি। হাবিবুল আউয়াল কমিশন হলো বাংলাদেশের ত্রয়োদশ নির্বাচন কমিশন।

২০২২ সালের অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ২৬ ফেব্রুয়ারি এই কমিশন গঠন করেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালসহ কমিশনের সদস্য ছিল ৫ জন। এই কমিশনের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী এই কমিশনের মেয়াদ ৫ বছর। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ২০২৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর আউয়াল কমিশন পদত্যাগ করে।

আলোকিত বাংলাদেশ : এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন-২০২২ পরিবর্তনে প্রস্তাব দেবেন কি না?

বদিউল আলম মজুমদার : আগামীতে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারে নির্বাচন কমিশন নিয়োগের জন্য আমরা এমন একটা আইনের খসড়া করব, যেটা হবে রাজনৈতিক ঐক্যমত্যেরভিত্তিতে। নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে- প্রধানমন্ত্রীর একজন প্রতিনিধি থাকতে পারেন, বিরোধী দলের একজন প্রতিনিধি থাকতে পারেন, তৃতীয় বৃহত্তম দলের একজন প্রতিনিধি থাকতে পারেন, গণমাধ্যমের একজন প্রতিনিধি থাকতে পারেন এবং নাগরিক সমাজের একজন প্রতিনিধি থাকতে পারেন। সরকার চাইলেই নিজের ইচ্ছামত নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিতে পারবে না। এগুলো মেনে চললে আগামীতে আমরা একটা ভালো নির্বাচন কমিশনার পাব।

আলোকিত বাংলাদেশ : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন সফল হয়েছে। এখন রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে আলোচনা চলছে। রাষ্ট্র সংস্কার কিভাবে হবে?

বদিউল আলম মজুমদার : আমাদের সংবিধান ও আইন-কানুন স্বৈরতান্ত্রিক বা কর্তৃত্ববাদী সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সহায়ক হয়েছে। কিছু কিছু আইনের বিধান রয়েছে, সেগুলো স্বৈরতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার সহায়ক, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইন মানা হয়নি। আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি। এগুলো পরিবর্তন করতে হবে। আইন মানাকে বাধ্য করা যাবে না, কিন্তু আইন না মানলে তার যেন প্রতিকার হয়। সংবিধান ও আইনে এমন কিছু রাখা যাবে না, যেটা স্বৈরতান্ত্রিক বা কর্তৃত্ববাদী সরকার সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। নির্বাচন কমিশনার পক্ষপাতদুষ্ট এবং পুলিশ পক্ষপাতদুষ্ট ছিল। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় চিরস্থায়ী থাকতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেছি। পঞ্চদশ সংশোধনী অসাংবিধানিকভাকে সংবিধানে যুক্ত করা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করে আনা সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন (রিভিউ) করেছি। আশা করছি আমরা প্রতিকার পাবো।

আলোকিত বাংলাদেশ : দেশের সংকট উত্তরণে রাজনৈতিক সংস্কার জরুরি কি না?

বদিউল আলম মজুমদার : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর বহু রাজনৈতিক নেতা পালিয়ে গেছেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকের বিপক্ষে ছিলাম। তবে আগামীতে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হবে কি না, সেজন্য অনেকের মতামত নেবো, এরপর প্রস্তাবনা তৈরি করা হবে।

আলোকিত বাংলাদেশ : আগামী নির্বাচন কী ইভিএমে হবে?

বদিউল আলম মজুমদার : ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে অনেক অভিযোগ আছে। ইভিএম অত্যন্ত দুর্বল। কারিগরী উপদেষ্টা কমিটির প্রধান প্রয়াত বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, প্রকৌশলী ও জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর সুপারিশ অমান্য করেই ইভিএম কেনা হয়েছিল। ইভিএম কেনাকাটায় অনিয়মের অভিযোগ আছে। যদি রাজনৈতিক ঐক্যমত্যের সৃষ্টি হয়, তাহলে আমরা নির্বাচনে টেকনোলজি ব্যবহারের কথা ভাববো। তবে বর্তমানে নির্বাচন কমিশন যেসব ইভিএম ব্যবহার করেছে, সেগুলো কোনোভাবেই নির্বাচনে ব্যবহারের যোগ্য নয়।

আলোকিত বাংলাদেশ : নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ নিয়ে মানুষের মাঝে নেতিবাচক ধারণা রয়ে গেছে। নেতিবাচক ধারণা দূরীকরণে কি ধরনের পদক্ষেপ নেবেন?

বদিউল আলম মজুমদার : রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যেমত্যেরভিত্তিতে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেয়া যেতে পারে, এতে সকলের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। স্বচ্ছতারভিত্তিতে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ পেলে প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকবে না।

আলোকিত বাংলাদেশ: বিগত আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসন আমলে জাতীয় নির্বাচন ও স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচনে যেসব পুলিশ, বিজিবি ও রিটার্নিং কর্মকর্তা দায়িত্বে ছিলেন, আগামী নির্বাচনগুলোতেও কী তারাই দায়িত্বে থাকবেন?

বদিউল আলম মজুমদার : আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি সবচেয়ে বড় বাঁধা। প্রশাসন দলীয়করণ বহু বছর ধরে চলে আসছে। বিএনপির আমলেও প্রশাসন দলীয়করণ হয়েছে, আওয়ামী লীগের আমলে প্রশাসন দলীয়করণ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। যদি আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে দিন বদলের নির্বাচনী ইশতেহারে সুস্পষ্টভাবে বলেছিল, তারা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দলীয়করণ করবে না। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দলীয়করণ করেছে, সেখানে কেউ তাদের বাঁধা দিতে পারেনি। আবারও প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দলীয়করণ করা হয় এবং আমরা যদি সেটি মেনে নেই, তাহলে আবারও আমাদের মাশুল দিতে হবে। সুতরাং রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন না এলে, কোন কিছুই হবে না।

আলোকিত বাংলাদেশ : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পর ৫ আগস্ট থেকে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিভিন্ন কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে, তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছেন। এক্ষেত্রে, আগামীর জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি কী সহজেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসতে পারবে বলে মনে করেন?

বদিউল আলম মজুমদার : আই ডোন্ট নো। এটা হচ্ছে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। আগে তারা (আওয়ামী লীগ) খেয়েছে, এখন তারা (বিএনপি) খাবে। এই সংস্কৃতি আমাদের বদলাতে হবে, কারণ আমাদের রাজনীতিটাই কুলষিত হয়ে গেছে। রাজনীতি আর রাজনীতি নাই, অপরাজনীতি হয়ে গেছে। রাজনীতি হলো- পাবলিক সার্ভিস (জনগণকে সেবা করা)। আর আমাদের রাজনীতি হয়ে গেছে ব্যক্তির সেবা, গোষ্ঠীর সেবা, পরিবারের সেবা। রাজনীতিটা ব্যবসায় পরিণত হয়ে গেছে। সেজন্য আমাদের মধ্যে পরিবর্তন করতে হবে, আমাদের মানসিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি, রাজনৈতিক দলের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে, তা না হলে কিছুই হবে না।

আলোকিত বাংলাদেশ : এক ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী নয়? রাজনৈতিক দলগুলো এমন সিদ্ধান্ত মানবে বলে মনে করছেন?

বদিউল আলম মজুমদার : রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে বহু ফাঁক-ফোকর বের করে ফেলবে। আমরা বাঙালি বহু ক্রিয়েটিভ।