ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ড. ইউনূস-বাইডেন বৈঠক

আলোচনায় থাকবে বাংলাদেশের সংস্কার ইস্যু

আলোচনায় থাকবে বাংলাদেশের সংস্কার ইস্যু

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় মঙ্গলবার দুপুরে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বৈঠকে বসবেন ইউনূস-বাইডেন। এই বৈঠকের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ নতুন ইতিহাস গড়তে যাচ্ছে। কারণ গত তিন দশকেও বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্টের এমন বৈঠক হয়নি। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে নিউইয়র্কে কোনো দেশের শীর্ষ নেতার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টের বৈঠক বিরল ঘটনা। সুতরাং ইউনূস-বাইডেনের বৈঠকটি ঐতিহাসিক বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্টের বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্যদিয়ে নতুন বাংলাদেশ বির্নিমাণে সংস্কার ইস্যু নিয়ে আলোচনা হতে পারে। একইসঙ্গে বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের টানাপড়েন এবং মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হবে। আঞ্চলিকভাবে অস্থিরতা দূরীকরণ কিংবা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কীভাবে বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে, এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা চাওয়া হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক বলেন, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রধানদের বৈঠকে স্বাভাবিকভাবে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা হবে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলার ফাঁকে কোনো দেশের শীর্ষ নেতার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দ্বিপক্ষীয় সাক্ষাৎ প্রায় বিরল। গত তিন দশকে জাতিসংঘের অধিবেশনের ফাঁকে বাংলাদেশের কোনো শীর্ষ নেতার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কোনো বৈঠক হয়নি। বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সঙ্গে সব সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সংবর্ধনায় দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে।

কূটনীতিকরা বলছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা সফর করে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ কয়েকজন উপদেষ্টা ও শীর্ষপর্যায়ের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল। একইসঙ্গে বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিতে ঋণের সহযোগিতার আশ্বাস দেয় প্রতিনিধিদল। দুই সপ্তাহের মাথায় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বৈঠক করছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিভিন্ন খাতের সংস্কারসহ বাংলাদেশের সামনের দিনের অগ্রযাত্রায় যুক্তরাষ্ট্র যেসব ধরনের সহায়তা করবে, নিউইয়র্কের আসন্ন বৈঠক সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ সভার পর পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়টি বিশেষ অগ্রাধিকারে রয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সংস্কার নিয়ে সরকারের ধারণা ও যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে এতে যুক্ত হতে পারে, তা নিয়ে ঢাকা সফররত উচ্চপর্যায়ের মার্কিন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাধারণ আলোচনা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতা করতে আগ্রহী।

পররাষ্ট্রসচিব জসীম উদ্দিন বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করতে চায়। সেটারই প্রতিফলন হিসেবে সরকার গঠনের দ্বিতীয় মাসেই যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছে। দ্বিতীয়ত, আর্থিক সংস্কারের যেসব খাত চিহ্নিত করা হয়েছে, তার সব ক’টি খাতে তারা সার্বিকভাবে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। শ্রম আইন নিয়ে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, সেগুলো তাদের জানানো হয়েছে এবং এই আলোচনা অব্যাহত থাকবে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, নিউইয়র্কে ড. ইউনূসের আগমন ঘিরে এখানকার বাঙালি কমিউনিটিতে বেশ উচ্ছ্বাস দেখা গেছে। এ বছরের অধিবেশন বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রাপ্তির ৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে। এ উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতে জাতিসংঘ সদরদপ্তরে বাংলাদেশ একটি উচ্চণ্ডপর্যায়ের সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছে। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদলের প্রধানের পাশাপাশি জাতিসংঘের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা, কিছু সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান, বিভিন্ন সংস্থার প্রধান অংশগ্রহণ করবেন।

আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ অধিবেশনে ভাষণ দেবেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি তার ভাষণে বিগত দুই মাসে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া অভাবনীয় গণ-অভ্যুত্থানের বিবরণ ও আগামী দিনে জনভিত্তিক, কল্যাণমুখী ও জনস্বার্থে নিবেদিত একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় তুলে ধরবেন। আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের বলিষ্ঠ অবস্থান, জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাব, জলবায়ু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, বিশ্বব্যাপী সংঘাত, রোহিঙ্গা সংকট, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিকূলতা, উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে সম্পদ পাচার প্রতিরোধ, নিরাপদ অভিবাসন, অভিবাসীদের মৌলিক পরিষেবা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা তার ভাষণে উঠে আসতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, সাধারণত দ্বিপাক্ষিক বৈঠকগুলো ওয়াশিংটনে হয়। নিউইয়র্ক মাল্টিলেটারাল (বহুপাক্ষিক), কাজেই এখানে সচরাচর এ ধরনের বৈঠক হয় না। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ড. ইউনূসের বৈঠক নিউইয়র্কে হলে এটা আমাদের জন্য ‘উল্লেখযোগ্য’ একটা ঘটনা হবে।

ইউনূস-বাইডেন বৈঠকে আঞ্চলিক সমস্যা, বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন নিয়ে আলাপের ভালো সুযোগ দেখছেন বর্তমানে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) সভাপতির দায়িত্বে থাকা সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির।

তিনি বলেন, বৈঠকে যদি প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কাছে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান সংক্ষেপে তুলে ধরা যায় তাহলে শুধু যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে কাজে লাগবে তা নয়। এ অঞ্চলে আমরা এখন যে প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছি এটাকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করার জন্য এ বৈঠক কাজে আসতে পারে।

হুমায়ুন কবির বলেন, আমরা এখন আঞ্চলিকভাবে প্রতিকূলতার মধ্যে রয়েছি। অভ্যন্তরীণভাবেও বেশ জটিল অবস্থা তৈরি হয়েছে। সেদিক থেকে এই বৈঠক খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ থাকলে যেটা হয়, মার্কিন শীর্ষ পর্যায়কে বাংলাদেশের এখনকার প্রেক্ষাপট তুলে ধরা যায় এবং এখনকার জন্য আমাদের প্রয়োজনীয় যেটুকু সমর্থন দরকার সে কথাটা তুলে আনা যায়। এটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। মার্কিনিদের একটা ইতিবাচক ভূমিকা আমাদের জন্য অনেক মূল্যবান বলে আমি মনে করি।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকের পাশাপাশি নিউইয়র্কে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ, নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি, বাহরাইনের ক্রাউন প্রিন্স হামাদ বিন ঈসা আল খালিফা, নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী ডিক শফ, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লিয়েনের সঙ্গে বৈঠক করবেন ড. ইউনূস। এছাড়া জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক, বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রধান কৌঁসুলি করিম খান, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার পরিচালক সামান্থা পাওয়ার, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেয়ার পর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্ক যাত্রা ড. ইউনূসের প্রথম বিদেশ সফর। ২৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ অধিবেশনে ভাষণ দেবেন ড. ইউনূস। জাতিসংঘে বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থানের বীরত্বগাথা তুলে ধরবেন ড. ইউনূস। ওই দিন রাতে নিউইয়র্ক থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেবেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত