ঢাকা ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বিশ্বমঞ্চে সমন্বয়কদের পরিচয় করিয়ে দিলেন ড. ইউনূস

আন্দোলনের ‘নেপথ্য কারিগর’ মাহফুজ আলম

আন্দোলনের ‘নেপথ্য কারিগর’ মাহফুজ আলম

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মানুষের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন, গুম ও হত্যাকাণ্ড যেন নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। এই অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা বিগত ১৫ বছরে রাজপথে বহুবার আন্দোলন সংগ্রাম চালিছেন। কিন্তু স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতন ঘটনানো সম্ভব হয়নি। তবে গত জুলাই ও আগস্টে রাজধানীসহ দেশজুড়ে ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতন ঘটেছে। আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়েছেন। তবে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেপথ্যের কারিগর হিসেবে কাজ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনের ফাঁকে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের ‘ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ লিডারস স্টেজ’ অনুষ্ঠানে যোগ দেন শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেই মঞ্চে মাহফুজ আলমসহ আর দুজন সমন্বয়কে পরিচয় করিয়ে দেন ড. ইউনূস।

অনুষ্ঠান মঞ্চে তিনি তার দীর্ঘদিনের বন্ধু সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সঙ্গে নানা বিষয়ে কথার ফাঁকে সফরসঙ্গীদের তিন জনকে পরিচয় করিয়ে দেন। গত মঙ্গলবার নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত ওই অনুষ্ঠানে মাহফুজ আলমকে সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলন ও পরে সরকার পতনের আন্দোলনের ‘নেপথ্য কারিগর’ (বিহাইন্ড দ্য হোল) হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন।

জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন যোগ দিতে যাওয়া ড. মুহাম্মদ ইউনূস নানা অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন। বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পেছনে থেকে ভূমিকা রাখা শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দেশের নেতাদের সঙ্গে পরিচয় করে দিচ্ছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

‘ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ লিডারস স্টেজ’ বক্তব্যে ড. ইউনূস বিগত সরকার কীভাবে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে এবং সেই তাজা গুলির সামনে কীভাবে ছাত্ররা বুক পেতে দাঁড়িয়েছে- বিশ্বনেতাদের সেসব কথা শোনান। একপর্যায় নতুন বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলা শুরু করেন। বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানের কথা বলার সময় তিনি দর্শকদের জানান, এখানে তাদের কয়েকজন প্রতিনিধি রয়েছে। এ সময় বিশেষ সহকারী মাহফুজসহ তিনজনকে স্টেজে আসতে বলেন ড. ইউনূস। বিল ক্লিনটনও তাদের নাম শুনে হাততালি দেন। তিনজনের মধ্যে একজন বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আয়েশা সিদ্দিকা তিথি।

ড. ইউনূস বলেন, তারা যেভাবে কথা বলে এরকম কথা আমি কখনো শুনিনি। তারা নতুন পৃথিবী, নতুন বাংলাদেশ গড়তে প্রস্তুত। প্লিজ আপনারা তাদের হেল্প করবেন। যেন তারা তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে। এ গুরুদায়িত্ব আমাদের সবার নিতে হবে। বিল ক্লিনটনের হাত ধরে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান বলেন, আপনি আমাদের সঙ্গে আছেন এ স্বপ্ন পূরণে।

তিনি বলেন, তাদেরকে দেখতে অন্য তরুণদের মতো মনে হলেও আপনি যখন তাদের কাজ দেখবেন, বক্তব্য শুনবেন- আপনিও অবাক হবেন। তারা সারাদেশ নাড়িয়ে দিয়েছে। অনেক কিছু হয়েছে, কিন্তু তারা তাদের বক্তব্য, ত্যাগ কিংবা কমিটমেন্ট থেকে পিছিয়ে যায়নি। তাদের বক্তব্য- ‘আপনারা চাইলে আমাদের হত্যা করতে পারেন, কিন্তু আমরা পথ ছেড়ে যাব না।’

এ সময় মাহফুজকে এগিয়ে দিয়ে ড. ইউনূস বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পেছনের কারিগর মাহফুজ। যদিও মাহফুজ সব সময় বলে, সে নয় আরো অনেকে আছে। যদিও সে গণঅভ্যুত্থানের পেছনের কারিগর হিসেবে পরিচিত। জুলাই-আগস্টের আন্দোলন খুব সুশৃঙ্খল ছিল জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এটা হঠাৎ করে হয়েছে এমন কিছু নয়। খুবই গোছানো আন্দোলন। এছাড়াও এত বড় আন্দোলন হয়েছে মানুষ জানতো না- কে আন্দোলনের লিডার? যার ফলে একজনকে আটক করা যেত না। বলাও যেত না যে, একজনকে আটক করলে আন্দোলন শেষ।

‘ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ লিডারস স্টেজ’ বক্তব্যে ড. ইউনূস তার বক্তব্য শুরু করেন সাবেক প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার স্মৃতিচারণ দিয়ে। কীভাবে প্রায় ৪০ বছর আগে এক প্রায় অপরিচিত মার্কিন শহরের গভর্নর তার বন্ধু হয়ে উঠলেন, কীভাবে ধীরে ধীরে ক্লিনটনের উদ্যোগে শুরু হওয়া গ্রামীণ কর্মসূচি যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫টি গুরুত্বপূর্ণ শহরে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ‘গ্রামীণ আমেরিকা’র এখন প্রায় ২ লাখ সদস্য রয়েছেন, যাদের সবাই নারী। তারা মোট দেড় হাজার কোটি ডলারের ঋণ নিয়ে ব্যবসা করছেন। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ১০ বছরে এই ঋণ বিতরণের পরিমাণ ৪ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছাতে পারে। তার বক্তব্যের সময় বারবার হাততালি দিতে থাকে উপস্থিত শ্রোতাবৃন্দ। এ সময় তার বুদ্ধিদীপ্ত বিভিন্ন কথায় মানুষ বারবার হেসে ফেলছিলেন।

বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে সামনে এগিয়ে আসেন ক্লিনটন। বন্ধু ড. ইউনূস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ড. ইউনূস তার দেখা একমাত্র বয়স্ক ব্যক্তি, যাকে নেতৃত্বে পেতে তরুণ সমাজ মরিয়া হয়ে ছিল। এমন হাস্যরসের পরেই বাংলাদেশের জুলাই-আগস্ট মাসের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও সেখানে ছাত্রদের অবদান তুলে ধরেন ড. ইউনূস। ‘এই আন্দোলনটা খুব সুশৃঙ্খল ছিল’, উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এটা হঠাৎ করে হয়েছে এমন কিছু নয়। খুবই গোছানো আন্দোলন। এছাড়াও এত বড় আন্দোলন হয়েছে মানুষ জানতো না, কে আন্দোলনের লিডার? যার ফলে একজনকে আটক করা যেতো না। বলাও যেতো না যে, একজনকে আটক করলে আন্দোলন শেষ।’

প্রসঙ্গত, মাহফুজ আলম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। প্রচন্ড মেধাবী মাহফুজ বিশ্ব রাজনীতি, সমাজনীতি, সমাজ গঠন, ব্রিটিশ ঔপনিবেশ আন্দোলন, ব্রিটিশ ভারত বিভাজনের পর থেকে হওয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক চুক্তি, সমঝোতা ও রাজনৈতিক মুভমেন্টগুলো সম্পর্কে সম্যক জ্ঞ্যান রাখেন। দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক নেতাদের মানসিক গঠন সম্পর্কেও ধারণা রাখেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পুরোটা সময়জুড়েই খুব আশাবাদী ছিল মাহফুজ। আন্দোলনের বিভিন্ন নামকরণ, আন্দোলনের ভাষা, কর্মসূচি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন সর্বস্তরের মানুষকে এক করতে। সহজবোধ্য এবং অর্থপূর্ণ এই নামগুলো; যেমন বাংলা ব্লকেড, মার্চ ফর জাস্টিস, কমপ্লিট শাটডাউন, রিমেম্বারিং দ্য হিরোজ, মার্চ টু ঢাকা এগুলো তারই মস্তিষ্কপ্রসূত। ব্যতিক্রমী সব কৌশলেই ছাত্রদের আন্দোলন পর্যায়ক্রমে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রূপ নেয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত