মশার কামড়ে মৃত্যু বাড়ছেই
প্রকাশ : ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
রাজধানীসহ সারাদেশে এডিস মশার কামড়ে মানুষের মৃত্যু বাড়ছে। ডেঙ্গুতে গতকালও দুইজনের মৃত্যু হয়েছে, হাসপাতালে ১ হাজার ২১৮ জন। এভাবে চলতে থাকলে সামনে ডেঙ্গুর পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্যবিদ ও কীটতত্ত্ববিদরা।
জানা গেছে, মশার কামড় থেকে নগরবাসীকে রেহাই দিতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা দুই সিটি কর্পোরেশন। তবে সংস্থা দুটির বেশকিছু উদ্যোগের পরও মশার কামড় থেকে রেহাই পাচ্ছে না রাজধানীবাসী। ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়লে তা সামলানো কঠিন হতে পারে।
কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, মশা নিয়ন্ত্রণে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। এতে মশার কামড়ের যন্ত্রণা সারা বছরই কমবেশি আলোচনায় থাকছে। একই সঙ্গে সিটি কর্পোরেশনের মশকনিধন উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
দুই সিটির কয়েকটি ওয়ার্ড সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন লালবাগকেল্লা, আজিমপুর, বকশিবাজার, নবাবপুর এলাকায় মশার উপদ্রবের তুলনায় নতুন ওয়ার্ড সারুলিয়া, ডেমরা, ঠুলঠুলিয়া, যাত্রবাড়ী মাতুয়াইলে মশার উপদ্রব বেশি। উত্তর সিটি কর্পোরেশনের গুলশান, মহাখালী, বনানী, তেজগাঁও ও বাড্ডা এলাকায় মশার উপদ্রব কম থাকলেও ভাষানটেক বাজার, খিলক্ষেত, উত্তর খান, দক্ষিণখানের ফায়দাবাদ ও কামারপাড়া এলাকার মানুষ মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বছরজুড়েই রাজধানীতে মশার উপদ্রব থাকছে। তবে যখন মশা বাড়ে, তখন হইচই হয়, আবার মশা কিছুটা কমলেই আলোচনা থেমে যায়। ঠিক একইভাবে সিটি কর্পোরেশন বিক্ষিপ্তভাবে মশানিধন কার্যক্রম চালাচ্ছে। তবে মশা নিয়ন্ত্রণে পুরো কার্যক্রমে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা (ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট) গড়ে তোলা দরকার। এতে মশার প্রজননস্থল কমবে, মশা নিয়ন্ত্রণে লার্ভিসাইড (লার্ভা মারার ওষুধ) এবং মশা নিয়ন্ত্রণে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে।
গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো ডেঙ্গুবিষয়ক নিয়মিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় ১ হাজার ২১৮ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৭ হাজার ৮০৮ জন। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে দুইজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এ নিয়ে চলতি বছর মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮৮ জনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সারাদেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ১ হাজার ২১৮ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকায়ই ৪২৫ জন রয়েছেন। এছাড়া ঢাকা বিভাগে ২৫৪ জন, বরিশালে ১০২ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ২২১ জন, খুলনায় ৯১ জন, ময়মনসিংহে ২১ জন ও রাজশাহীতে ৬৮ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৭ অক্টোবর পর্যন্ত সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৭ হাজার ৮০৮ জন। তাদের মধ্যে ৬৩ দশমিক ২ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৬ দশমিক ৮ শতাংশ নারী। একই সময়ে মারা যাওয়া ১৮৮ জনের মধ্যে ৫০ দশমিক ৫ শতাংশ নারী এবং ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশ পুরুষ। প্রতি বছর বর্ষাকালে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। ২০২৩ সালের জুন মাস থেকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। গেল বছর দেশে ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন। এর মধ্যে ঢাকায় ১ লাখ ১০ হাজার ৮ জন এবং ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নিয়েছেন ২ লাখ ১১ হাজার ১৭১ জন।
আক্রান্তদের মধ্যে হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন ৩ লাখ ১৮ হাজার ৭৪৯ জন। গত বছর ১ হাজার ৭০৫ জন মশাবাহিত এই রোগে মারা গেছেন, যা দেশের ইতিহাসে ১ বছরে সর্বোচ্চ মৃত্যু। এর আগে ২০১৯ সালে দেশব্যাপী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন। ওই সময় চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীসহ প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও ২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। ওই বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এছাড়া ২০২২ সালে ডেঙ্গু নিয়ে মোট ৬২ হাজার ৩৮২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ওই বছর মশাবাহিত রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে ২৮১ জন মারা যান।
যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলার কারণে মশা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন যাত্রাবাড়ী এলাকার বাসিন্দারা। সড়কের পাশে ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। নালা-নর্দমায় অপরিষ্কার পানি জমে থাকা, নিয়মিত পরিষ্কার না করায় মশার বিস্তার চরম আকার ধারণ করেছে। মাতুয়াইল এলাকার গৃহিণী জাহানারা আহমেদ বলেন, এই এলাকায় মশার উৎপাত বেড়েছে। কয়েল জ্বালিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না।
মশার যন্ত্রণায় তার সন্তানরা ঠিকমতো লেখাপড়া করতে পারছে না। একই অবস্থা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকায়। উত্তর সিটির কামারপাড়া এলাকার বাসিন্দা মুসলিম মিয়া বলেন, মশার কামড়ে কোথাও বসার সুযোগ নেই। বাসায় বসে থাকলেও দিনে-রাতে মশা কামড়ায়। সেজন্য কয়েল জ্বালিয়ে মশা তাড়াতে হয়, দু’এক মিনিট কয়েল না জ্বালালে মশা কামড়ায়। মাঝে মাঝে সিটি কর্পোরেশনের লোকজন ফগার মেশিন দিয়ে ধোঁয়া দিয়ে যায়। ধোঁয়া কমে গেলেই সেই আগের মতোই মশা কামড়ানো শুরু করে। মশা যেমন ছিল, ঠিক তেমনই থাকে। ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার না করে শুধু ফগিং করা হয়। এ জন্য মশার উপদ্রব কমছে না বলে মনে করেন তিনি।
বাড্ডার একাধিক বাসিন্দা বলেন, মশা মারা নিয়ে মশকরা অনেক হয়েছে। মানুষ এখন মশার কাছে জিম্মি। মশার উপদ্রবে দিনে মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতে হয়। মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি। জিহাদুল ইসলাম বলেন, উত্তরার পথঘাটের কোথাও দাঁড়াতে পারি না মশার কারণে। হাত-পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে মশা এমনভাবে কামড়ায় যেন মনে হয় শরীরে পিঁপড়া কামড়াচ্ছে। মশার জ্বালায় টেকা যায় না।
মশা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার আলোকিত বাংলাদেশকে বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে মশক নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কথা বলে আসছি। কারণ সমগ্র বিশ্বে সমন্বিতভাবে খুব সহজেই মশক নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে ১২৩ প্রজাতির মশার রেকর্ড রয়েছে। তার মধ্যে বর্তমানে ঢাকায় প্রায় ১৪ প্রজাতির মশা দেখা যায়। মশার প্রতিটি প্রজাতির প্রজনন, আচরণ ও রোগ বিস্তারের ক্ষমতা ভিন্ন। এদের ঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে মশার প্রজাতি ও আচরণভেদে নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা আলাদা আলাদাভাবে নিতে হবে। সেজন্য সমন্বিত ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন। সমন্বিত ব্যবস্থাপনার চারটি অংশ রয়েছে- পরিবেশগত, জীবন, রাসায়নিক ও মশা নিয়ন্ত্রণে জনগণের অংশগ্রহণ। এছাড়াও সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা ঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য সিটি কর্পোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডকে দশটি ব্লকে ভাগ করে কার্যক্রম চালাতে হবে। প্রতিটি ব্লকে এন্টোমোলজি টেকনিশিয়ান, স্প্রেম্যান ও ক্লিনার থাকতে হবে বলে জানান এই কীটতত্ত্ববিদ।