সারাদেশে প্রতিদিন এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। গতকালও দুইজন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। এ নিয়ে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ২০১ জন মারা গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়, গতকাল ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৪৯০ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এরমধ্যে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ২২৫ জন এবং বাকিরা ঢাকার বাইরের। এ সময়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন ৪৬১ জন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪০ হাজার ৮৯৫ জন। এর মধ্যে ছাড়পত্র পেয়েছেন ৩৭ হাজার ১৭২ জন।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ড. আতিকুর রহমান জানান, ডেঙ্গু এখন সিজনাল নেই, সারা বছরই হচ্ছে। বৃষ্টি শুরু হলে এটা বাড়ছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশা নিরোধক ওষুধ ব্যবহারের পাশাপাশি সিটি কর্পোরেশনে পক্ষ থেকে সব জায়গায় প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। একইসঙ্গে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। কীটতত্ত্ববিদ ড. মনজুর চৌধুরী বলছেন, মশা নিধনে শুধু জেল-জরিমানা আর জনসচেনতনা বাড়িয়ে কাজ হবে না। সঠিকভাবে জরিপ চালিয়ে দক্ষ জনবল দিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রতি বছর বর্ষাকালে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। ২০২৩ সালের জুন মাস থেকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। গেল বছর দেশে তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন। এর মধ্যে ঢাকায় ১ লাখ ১০ হাজার ৮ জন এবং ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নিয়েছেন ২ লাখ ১১ হাজার ১৭১ জন। আক্রান্তদের মধ্যে হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন ৩ লাখ ১৮ হাজার ৭৪৯ জন। গত বছর ১ হাজার ৭০৫ জন মশাবাহিত এই রোগে মারা গেছেন, যা দেশের ইতিহাসে ১ বছরে সর্বোচ্চ মৃত্যু। এর আগে ২০১৯ সালে দেশব্যাপী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন। ওই সময় চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীসহ প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও ২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। ওই বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এছাড়া ২০২২ সালে ডেঙ্গু নিয়ে মোট ৬২ হাজার ৩৮২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ওই বছর মশাবাহিত রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে ২৮১ জন মারা যায়।
জানা গেছে, অক্টোবরের প্রথম ৯ দিনেই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ৩৩ জন মারা গেছে। ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ১০টি সমন্বয়ক ও তদারক কমিটি গঠন করেছে। প্রতিটি কমিটিতে মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ৭ জন অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ কর্মকর্তা রয়েছেন। মশক নিধন অভিযান বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগের সকল সিটি কর্পোরেশন এবং ঝুঁকিপূর্ণ পৌরসভায় কাজ করছে ৩ হাজার ২১৪ জন মশককর্মী।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছরে জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ৩৯ হাজার ৮২২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন, মারা গেছেন ১৯৬ জন এবং হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন ৩৬ হাজার ১৫১ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এই পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)। এখানে আক্রান্ত হয়েছেন ৮ হাজার ৬৫৭ জন এবং মারা গেছেন ১০৬ জন। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)। এই সিটিতে আক্রান্ত হয়েছেন ৮ হাজার ৬৭ জন এবং মারা গেছেন ২৭ জন।
আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যার বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে একটি ভুল বুঝাবুঝি হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে যে সংখ্যা দেয়া হয় তা হাসপাতালের রোগী কেন্দ্রীক। দেশের সবচেয়ে বড় বড় হাসপাতালগুলোর অবস্থান ডিএসসিসিতে হওয়ায় এখানে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেশি দেখানো হয়। এরপরও বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা নিধনে আমাদের কার্যক্রম সঠিকভাবেই চলছে।
চলতি মৌসুমে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় মশক নিধন অভিযান কর্মসূচি বাস্তবায়ন, সমন্বয় ও নিবিড়ভাবে তদারকি করতে এরই মধ্যে ১০টি টিম গঠন করা হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে ৪টি টিম এবং উত্তর সিটি কর্পোরেশনে ৩টি টিম কাজ করছে। নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনসহ অন্যান্য সিটি কর্পোরেশন এলাকায় কাজ পরিচালনার জন্য পৃথক একটি টিম গঠন করা হয়েছে। গত ২৩ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি কর্পোরেশনসহ সারাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলা সংক্রান্ত স্থানীয় সরকার বিভাগের এক জরুরি সভায় কমিটিগুলো গঠন করা হয়। এছাড়াও, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা সাভার, দোহার, তারাব, রূপগঞ্জ ও অন্যান্য পৌরসভার জন্য আরও একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
ডেঙ্গুরোগের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলার কাজ সমন্বয় এবং তথ্য সংগ্রহের জন্য ৭ সদস্য বিশিষ্ট কমিটিতে স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্মসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের টিম প্রধান করা হয়েছে। গঠিত টিমগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩টি ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাব এলাকা পরিদর্শন এবং ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধ কার্যক্রম মনিটরিং ও তদারকি করছেন।
স্থানীয় সরকার বিভাগের তথ্য সংগ্রহ কমিটির কাছে নিয়মিতভাবে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় নেয়া পদক্ষেপ এবং অভিযান পরিচালনা সংক্রান্ত সচিত্র প্রতিবেদন দাখিল করছেন। এই কমিটি ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ থেকে নাগরিকদের রক্ষা করতে জনসচেতনতা সৃষ্টি, মশার প্রজননস্থল বিনষ্ট, পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা এবং লার্ভা ও মশা নিধনসহ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।
ঢাকা ছাড়াও আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা সাথে পাল্লা দিয়ে দেশের অন্যান্য জেলায়ও। রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে এখনই ডেঙ্গু রোগীর উপচে পড়া ভিড়। চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক, নার্সসহ সংশ্লিষ্টরা। হাসপাতালে দেখা দিয়েছে শয্যা সংকট।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির আওতাধীন মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন রাজধানীর শান্তিনগর এলাকার বাসিন্দা দিনমজুর সেলিম উদ্দিন। তিনি বলেন, গত ৫ দিন ধরে মুগদা হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। শুরুতে শারীরিক অবস্থা খারাপ থাকলেও বর্তমানে কিছুটা উন্নতির দিকে। তিনি বলেন, ‘তাদের এলাকায় দিনে রাতে সার্বক্ষণিক মশার কামড়ে অতিষ্ঠ মানুষ। মশক নিয়ন্ত্রণে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে কোন ওষুধ ছিটানো হয় না।’
রাজধানীর দক্ষিণ বনশ্রীর বাসিন্দা মিজানুর রহমান জানান, মশার কামড়ে দিনের বেলায়ও টেকা দায়। মাঝেমধ্যে সিটি কর্পোরেশনের কর্মীদের মশার প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে ওষুধ ছিটানোসহ ফগিং করতে দেখা যায়। এরপরও মশার উপদ্রব্য কমেনি।