রাজনৈতিক শক্তি দেখাতে মরিয়া জামায়াত
প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক, সামাজিক এবং কূটনৈতিক তৎপরতায় নতুন করে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রায় দেড় দশকের বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক কোণঠাসা অবস্থানে থাকা জামায়াত এখন নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে ধারাবাহিক কর্মসূচির মাধ্যমে এগিয়ে চলেছে। সারাদেশে দলকে মজবুত করতে বহুমুখী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে তারা। এরই অংশ হিসেবে রাজধানীতে মহাসবামেশ করবে জামায়াত।
জানা যায়, আগামী ২৮ অক্টোবর ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জামায়াতে জনসভা হতে পারে। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর দলীয় ব্যানারে রাজধানীতে এটিই হবে জামায়াতের প্রথম সমাবেশ।
গত ৯ অক্টোবর জামায়াতে ইসলামীর প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সমন্বয়ক আব্দুস সাত্তার সুমন গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তারা ঢাকায় একটি মহাসমাবেশ করবেন। তিনি বলেন, সমাবেশের বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। এটি নিয়ে আমাদের আলোচনা চলছে।
তিনি জানান, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটে জামায়াতের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হামলা এবং নৃসংশভাবে মানুষ হত্যার প্রতিবাদে এই সমাবেশটি হতে পারে।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার গণমাধ্যমে বলেন, আমরা পরিকল্পিতভাবে কর্মকাণ্ড করছি। মিছিল, সভা-সমাবেশ, সংগঠন সম্প্রসারণ, আমাদের জনশক্তির মানোন্নয়ন, দেশ গড়ার জন্য জনগণকে সচেতন করে একটা নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে সাহায্য করা- এগুলোই আমাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড।
সূত্র জানায়, ছাত্র আন্দোলনে সহিংসতার পেছনে জামায়াত ও তাদের সহযোগী ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির জড়িত ছিল বলে অভিযোগ তুলেছিল বিগত সরকার। আন্দোলন দমানোর কৌশল হিসেবে জামায়াত ও শিবিরকে নিষিদ্ধ করেও তারা। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন ও জামায়াত-শিবিরের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনে ব্যাপক হত্যা ও দমন-পীড়নও চালানো হয়। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। তীব্র গণআন্দোলন দমনে সেনাবাহিনীর অস্বীকৃতি জানানো সরকারের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়। গণভবন ছাড়তে হয় শেখ হাসিনাকে। বদলে যাওয়া রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জামায়াতের প্রভাবশালী হয়ে ওঠার বিষয়টি বোঝা যায় ৫ আগস্ট বিকেলেই। এদিন জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। সেখানে তিনি উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার কথা বলেন। প্রথমেই সেনাপ্রধান দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নাম উল্লেখ করেন। অথচ তখন পর্যন্ত নির্বাহী আদেশে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল।
তখন সেনাপ্রধানের ভাষণে জামায়াতের নাম উল্লেখ থেকেই ইঙ্গিত মেলে দলটি বাংলাদেশের রাজনীতি প্রভাবশালী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে যাচ্ছে। পরে ড. মুহম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে শপথ নেওয়ার ২০ দিন পর জামায়াত নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন বাতিল করে সরকার।
গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দুই মাস পর জামায়াতের প্রভাব ও সক্রিয়তা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক পরিসর ও ভবিষ্যতে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিজেদের শক্তি দেখাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে দলটি। নিজেদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড বাড়ানোর পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারের নানা নীতিকে প্রভাবিত করতেও সক্রিয় জামায়াত। সম্প্রতি দলটি অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কারে ১০ দফা দাবি দিয়েছে। এতে নির্বাচনি প্রক্রিয়া, আইন, বিচারব্যবস্থা, এবং সংসদীয় প্রতিনিধিত্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এর পাশাপাশি দলটি কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের ওপরও জোর দিচ্ছে। বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে নিয়মিত যোগাযোগ শুরু করেছে জামায়াত। এরইমধ্যে চীনের রাষ্ট্রদূতসহ বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কূটনীতিক দলটির সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা জানিয়েছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ৭ জানুয়ারি থেকে জামায়াত সংগঠনকে নতুন করে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেয়।
শেখ হাসিনার পতনের পর এই কার্যক্রম জোরালো হয়। দলটি দেশব্যাপী মহানগর থেকে শুরু করে থানা ও উপজেলা পর্যায়ে রুকন (সদস্য) সম্মেলন আয়োজন করে। পাশাপাশি নবাগত ও অগ্রসর কর্মীদের জন্য শিক্ষাশিবির, সহযোগী সদস্যদের সভা এবং কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা ও নির্বাহী পরিষদের একাধিক সভা এবং বিশেষ রুকন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব কর্মকাণ্ড এখনও বিভিন্ন এলাকায় অব্যাহত চলছে। যেখানে দলের শীর্ষ নেতারা তৃণমূলের নেতাকর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য দিয়ে উদ্বুদ্ধ করছেন।
কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নেও জোর চেষ্টা চালাচ্ছে জামায়াত। পাকিস্তানপন্থি ও ভারতবিরোধী হিসেবে জামায়াতের পরিচিতি রয়েছে। তবে গত আগস্টে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় দলটির আমির শফিকুর রহমান জানান, তারা ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে আগ্রহী। ভারত কষ্ট পাবে জামায়াত এমন কিছু করবে না বলেও দাবি করেন তিনি। তবে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে পারস্পারিক সম্মান ও মর্যাদার ওপরেও জোর দেন তিনি। অভ্যুত্থানের পর এখন জাপান, চীন, ইরানসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করে কর্মপন্থা ঠিক করছে জামায়াত।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাজনীতির মাঠে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। ফাঁকা জায়গায় একটি বড় শক্তি হিসেবে আসতে চাইছে জামায়াত। এ জন্য মাঠ গোছানোর জন্য সময় প্রয়োজন দলটির। কারণ প্রায় দেড় যুগ ধরে দলটি কোণঠাসা অবস্থায় ছিল। এ কারণে নির্বাচন দেরিতে চায় জামায়াত। একইসঙ্গে বিভিন্ন কর্মসূচি ও তৎপরতার মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গনে নিজেদের শক্তিরও জানান দিতে চায় তারা।
সার্বিক বিষয়ে জামায়াতের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, আমরা পরিকল্পিতভাবে কর্মকাণ্ড করছি। মিছিল, সভা-সমাবেশ, সংগঠন সম্প্রসারণ, আমাদের জনশক্তির মানোন্নয়ন, দেশ গড়ার জন্য জনগণকে সচেতন করে একটা নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে সাহায্য করা- এগুলোই তো আমাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড।