সারাদেশে জন্মনিবন্ধন নিয়ে চরম ভোগান্তিতে পরেছে সাধারণ মানুষ। নতুন জন্মনিবন্ধন পেতে দীর্ঘসূত্রতা, সংশোধন পুরোপুরি বন্ধ এবং জন্মনিবন্ধন বাতিল কার্যক্রম বন্ধ থাকায় চরম ভোগান্তিতে পরেছে সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের তৈরি নিজস্ব সার্ভারে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন করায় অসহায় হয়ে এক অফিস থেকে আরেক অফিসে ঘুরছে ৭৯ হাজার নাগরিক।
সূত্র জানায়, সেবার নামে প্রায় এক বছর ধরে প্রায় ৭৯ হাজার ‘ভুয়া’ জন্মনিবন্ধন সনদ বিতরণ করেছে ডিএসসিসি। এসব সনদের কোনোটির সঙ্গেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের (জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন) সার্ভারের তথ্যের মিল নেই। যারা ডিএসসিসি থেকে জন্মসনদ নিয়েছেন, তারা প্রত্যেকেই ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। এসব সনদে দেশে কোনো ধরনের নাগরিক সেবা মিলছে না।
ডিএসসিসির জনসংযোগ বিভাগ সূত্র জানায়, আগে জাতীয় সার্ভারের মাধ্যমেই জন্মসনদ বিতরণ করা হতো। কিন্তু সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের আপত্তিতে এই বিপত্তি ঘটে। তার নির্দেশেই আইনবহির্ভূতভাবে প্রায় সাড়ে ১০ মাসে দক্ষিণ সিটি থেকে প্রায় ৭৯ হাজার জন্ম নিবন্ধন এবং ১ হাজার ৪৭১টি মৃত্যু নিবন্ধন বিতরণ করা হয়েছে। এখন এসব সনদের তথ্য রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে হস্তান্তর করা হয়েছে। তারা নাগরিকদের তথ্যগুলো জাতীয় সার্ভারে যুক্ত করবেন। গত প্রায় ১ বছর ধরে দক্ষিণ সিটি থেকে যারা জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন করেছেন, তাদের কি আবার নতুন করে নিবন্ধন করতে হবে কি না জানতে চাইলে জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের বলেন, আগে বিতরণ করা সনদগুলো বাতিল হবে না। ওই নিবন্ধনগুলোর তথ্য কেন্দ্রীয় সার্ভারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এসব তথ্য শুধু জাতীয় সার্ভারে যুক্ত হবে। পরে শিশুদের স্কুলে ভর্তি, পাসপোর্টসহ সব সেবা নিতে পারবেন নাগরিকরা। জানা যায়, ঢাকায় এক বছরে জন্মনিবন্ধনের সংখ্যা কমেছে প্রায় ৩ লাখ। সার্ভার জটিলতার পাশাপাশি কাউন্সিলররা পলাতক থাকায় ভোগান্তি বেড়েছে কয়েকগুণ। ফলে নিবন্ধন বা সংশোধনীর জন্য নাগরিকদের ছুটতে হচ্ছে এক অফিস থেকে আরেক অফিসে। তবে সিটি কর্পোরেশন ও রেজিস্ট্রার অফিসের দাবি, দালালদের কাছে যাওয়ায় বাড়ছে ভোগান্তি।
জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী, জন্মগ্রহণের পর জন্মণ্ডনিবন্ধীকরণের কথা বলা হয়েছে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে শিশুর জন্মের পরই নিবন্ধন করা হয়। বাংলাদেশেও নিবন্ধনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
২০১০ সাল থেকে অনলাইনে শুরু হয় জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন। রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের তথ্য মতে, ২০২৩ সালে বছরের প্রথম ৯ মাসে জন্মনিবন্ধন হয়েছে ৬১ লাখ ৩৭ হাজার। আর চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই সংখ্যা ৫৮ লাখ ৪৪ হাজারের কিছু বেশি।
সূত্র জানায়, পাসপোর্ট, সরকারি-বেসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় চাকরি, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও জাতীয় পরিচয়পত্র পেতে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে জন্মনিবন্ধন থাকা বাধ্যতামূলক। গত বছরের মে মাস থেকে সারা দেশে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের আবেদনের ফি অনলাইনে নেয়া শুরু হয়। এরপরই নতুন ধরনের ভোগান্তিতে পড়ার অভিযোগ তুলেছেন নাগরিকরা। আর সার্ভার ডাউন ও অব্যবস্থাপনায় হঠাৎ কমে আসে জন্মনিবন্ধনের সংখ্যা।
জয়পুরহাট থেকে ঢাকা জন্মনিবন্ধনের ভোল সংশোধন করতে এসেছেন শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমার জন্মনিবন্ধনে ভুল এসেছে। এ কারণে সংশোধন করা প্রয়োজন। কিন্তু এলাকায় স্থানীয় অফিসে ঘুরে কোনোভাবে সংশোধন করতে পারিনি। এ কারণে ঢাকায় রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে এসেছি। এ অফিস থেকে বলা হয়েছে, এখন কোনো জন্মনিবন্ধন সংশোধন করা যাচ্ছে না, সার্ভারের সমস্যা। আমি বিদেশ যাব, জন্মনিবন্ধন সংশোধন না করতে পারলে বড় বিপদে পরে জাবেন বলে জানিয়েছেন শফিকুল ইসলাম।
ঢাকার হাজারীবাগের বাসিন্দা দিদার ছেলের জন্মনিবন্ধন করতে ঘোরছেন স্থানীয় অফিসে। কিন্তু এ অফিসে কর্যক্রম বন্ধ থাকায় তিনি বিপাকে পরেছেন। দিদার বলেন, আমার ছেলের পাসর্পোট করবো কিন্তু জন্মনিবন্ধন করতে পারছি না। কবে চালু হবে, সে বিষয়ে কোনো ধারণা পাইনি।
এদিকে, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে (ডিএনসিসি) জন্মনিবন্ধন সেবা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। বছরখানেক আগে স্থানীয় সরকার বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী, জন্মসনদ বিতরণের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সম্প্রতি আবার আগের মতো ডিএনসিসির আঞ্চলিক অফিস থেকে জন্মসনদ বিতরণের নির্দেশনা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার বিভাগ। এ কারণে এখন জন্ম নিবন্ধন আবেদন ও সনদ বিতরণ বন্ধ রয়েছে। এতে নাগরিক ভোগান্তি আরো বাড়ছে।
জন্মনিবন্ধন করা কেন জরুরি : জন্মসনদ হলো একজন মানুষের জন্ম, বয়স, পরিচয় ও নাগরিকত্বের প্রমাণ। রাষ্ট্রের স্বীকৃত নাগরিকের মর্যাদা ও সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে হলে জন্ম নিবন্ধন সনদ প্রদর্শন করা বাধ্যতামূলক। এখন স্কুলে ভর্তি, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইন্সেন্স ইস্যুসহ দেশের ২২টির সেবা কাজে জন্মনিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আর শিশুর জন্মের ৪৫ দিন বা দেড় মাসের মধ্যে জন্ম নিবন্ধন করতে হবে। তবে এ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিবন্ধন না করা হলে ১৮ বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এটি করতে পারবেন। তবে ১৮ বছর পার হলে ৫০ টাকা ফি দিয়ে নিবন্ধন করতে হবে।
রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. যাহিদ হোসেন বলেন, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমরা সারাদেশে ৫৮ লাখ জন্ম নিবন্ধন করেছি। আরো ২৭ লাখ জন্মনিবন্ধন সংশোধন করা হয়েছে। এ হিসেবে প্রায় ১ কোটি মানুষের সনদ বিতরণ করতে পেরেছি। আর এখন সার্ভারে তেমন ত্রুটি নেই। আমাদের কার্যক্রম চলছে।