বছরের পর বছর ঘুরেও মামলার সুরাহা হয় না

প্রকাশ : ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

দুই যুগ আগে জমি নিয়ে বিরোধে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন গোলজার রহমান। মামলা করলেও তার জীবনদশায় মামলার সুরাহা দেখে যেতে পারেনি। তার মৃত্যুর পর মামলাটি নিয়ে এখন লড়ছেন তার ছেলে হাসান গালীপ। তিনিও মামলার চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষায় আদালতের বারান্দায় বারান্দায় ঘুরছেন। বছরের পর বছর আদালতে গিয়ে মামলার হাজিরা দিচ্ছেন আর টাকা খোয়াচ্ছেন। কিন্তু চূড়ান্ত রায় মিলছে না। এভাবেই যুগের পর যুগ আদালতের বারান্দায় বারান্দায় ঘুরে ঘুরে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বিচারপ্রার্থীদের।

বিচারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, দেওয়ানি মামলা যুগের পর যুগ ঝুলে আছে আদালতে। ঝুলানো মামলা চালাতে গিয়ে বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন বাদী-বিবাদীরা। দেশে বিচারক সংকট, মামলার আধিক্য, অভিযোগপত্রে নারাজি, মামলার নিষ্পত্তিতে আইনজীবীদের গাফিলতি থাকায় আর্থিকভাবে আইনজীবীরা লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বাদী-বিবাদীরা।

জানা গেছে, গোলজার রহমান বাড়ির পাশে জমি কেনার পর তার জায়গার ওপর মামলা হয়। পিতার মৃত্যুর পর মামলায় হাজিরার দিন আইনজীবীর ফিসহ কোর্টে আসেন ছেলে হাসান গালীপ। তিনি বলেন, কবে মামলার রায় হবে, কবে জমি ফিরে পাবেন তা নিশ্চিত নন। বছরে পর বছর এভাবে মামলা চলতে থাকায় আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি পারিবারিকভাবে ক্ষতির মুখোমুখি হতে হচ্ছেন তিনি। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। মামলার কারণে হাসান গালীপ নিজ এলাকার বাইরে গিয়ে চাকরি করতে পারছেন না। বার বার আদালতে হাজিরার তারিখ নির্ধারিত হয়, কিন্তু চূড়ান্ত রায় ঝুলে থাকছে।

মামলার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৪৩ লাখ ২৬ হাজার ৬৫৫টি। এর মধ্যে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে ২৭ হাজার ৮৬ এবং হাইকোর্ট বিভাগে ৫ লাখ ৫৬ হাজার ৯২৬টি মামলা বিচারাধীন। অধস্তন আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৮ লাখের কাছাকাছি। এর মধ্যে দেওয়ানি মামলা প্রায় ১৬ লাখ এবং ফৌজদারি মামলা ২২ লাখের কাছাকাছি। এসব মামলার মধ্যে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে ঝুলছে ৭ লাখ ৩৫ হাজার ৩৬২টি মামলা। এর মধ্যে ৪ লাখ ২৪ হাজার ৭৪৮ দেওয়ানি এবং ৩ লাখ ১০ হাজার ৬১৪টি ফৌজদারি মামলা।

আইন বিশেজ্ঞরা বলছেন, আদালতে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা কমবেশি সবার জানা। সব মামলা নিষ্পত্তিতে অনেক সময় লাগে, বিষয়টি এমন নয়। তবে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। বিচার বিভাগে এমন একটা অবস্থা তৈরি করা হয়েছে যে মানুষের দিন দিন বিচার বিভাগের ওপর আস্থা হ্রাস পেয়েছে। সম্পত্তির অধিকার সম্পর্কিত দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে সমন জারি ও গ্রহণে দেরি, বারবার সময়ের আবেদন, ওয়ারিশদের পক্ষভুক্তি, আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাওয়া, বিচারাধীন আদালতের প্রতি অনাস্থা এনে বিবিধ মামলা করা, ভূমি পরিমাপে কমিশন নিয়োগের দেরি, আরজি সংশোধন, বারবার আপত্তি দিয়ে সময়ক্ষেপণের কারণে ঝুলে থাকে মামলাগুলো।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মামলা নিষ্পত্তিতে গড়িমসি করা, বাদীদের তথ্য না জানানো, সাক্ষী ও বাদী হাজির হলে ফিরিয়ে দেয়া, মামলা পরিচালনা না করে বছরের পর বছর শুধু দিন ধার্য করে বাদী ও বিবাদীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে আইনজীবীদের বিরুদ্ধে। তবে আইনজীবীদের দাবি, মামলা নিষ্পত্তিতে তারা যথেষ্ট আন্তরিক। কিন্তু পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন কারণে নিষ্পত্তিতে দেরি হয়।

আইন মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মামলারজট বাড়লেও অন্তর্বর্তী সরকার সেই মামলারজট কমানোর চেষ্টা করছে। এরই মধ্যে বিচারিক কার্যক্রমের গতি ফেরাতে বেশকিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার পর মূলত একটি সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিল। এ সময়ে মামলাজট নিরসনে তেমন কার্যকর কোনো পদক্ষেপ আমাদের চোখে পড়েনি। তিনি বলেন, দেশের জনসংখ্যার তুলনায় যে পরিমাণ বিচারক ও আদালত থাকার কথা ছিল তার কোনোটাই হয়নি। বরং ভৌতিক মামলা দিয়ে মামলার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা হয়েছে।

সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট আহসানুল করিম আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, বিচাকরা ছোট খাটো মামলা নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকায় দেওয়ানি মামলাগুলোর কোন সুরাহা হচ্ছে না। এছাড়াও অধস্তন আদালতে দৈনিক শতশত দেওয়ানি মামলা হচ্ছে, বিচারক একটি মামলার শুনানি শেষে চূড়ান্ত রায়ের জন্য কয়েক ঘণ্টা সময় লাগে। আদালতে বিচারকদের সংকট রয়েছে।

তিনি আরো বলেন, বিচারক নিয়োগের পর পর্যাপ্ত ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা থাকতে হবে। কিছু মামলা রয়েছে যেগুলো বিচারকরা বুঝে উঠতে পারেন না। সেজন্য কিছু মামলা ৬০ থেকে ৭০ বছর পর্যন্ত আদালতে ঝুলছে।