ঢাকা ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ৮ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে সংশয়

নির্বাচনি ব্যবস্থার সংস্কারে মতামত চেয়েছে কমিশন
নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে সংশয়

আগামী সংসদ নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছে বিভিন্ন মহল। এ নির্বাচন নিয়ে একেক সময় একেক কথা বলছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এ ধরনের বক্তব্যে রাজনৈতিক দল ও নেতাদের কাছ থেকে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

সূত্র জানায়, অন্তর্বর্তী সরকার বলে আসছে দেশ সংস্কার করে নির্বাচন দিয়ে উপযুক্ত সময়ে ভোট দেয়া হবে। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলো চায় সময়সীমা বা রোডম্যাপ দিয়ে দ্রুত নির্বাচন। এমন অবস্থায় বিভিন্ন মহল থেকে একাধিক বক্তব্য আসায় বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। সর্বশেষ নির্বাচন নিয়ে বক্তব্য দেয়ার পরে তার ব্যাখ্যা দিয়ে আলোচনায় এসেছেন সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।

গত বৃহস্পতিবার একটি টিভিতে আলোচনার সময় তিনি বলেন, আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে। পরে গত শনিবার দেয়া ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন এটি একান্তই প্রধান উপদেষ্টার সিদ্ধান্তের বিষয়।

এমন পরিস্থিতিতে অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি মনে করছে, নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অস্পষ্টতার কারণে জনমনে সন্দেহ বা সংশয় তৈরি হচ্ছে। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেই এ সংশয়ের প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, সরকার হয়তো ক্ষমতা আকড়ে রাখার চিন্তা থেকে কিছু করছে না, কিন্তু সুনির্দিষ্ট সময়সীমা ঠিক না করার কারণেই ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য আসছে, যা নির্বাচন নিয়েই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সন্দেহের উদ্রেক ঘটাচ্ছে।

এর আগে নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে সেনাপ্রধান এক থেকে দেড় বছরের কথা বললেও প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, তারা যখন ঘোষণা করবেন সেটিই হবে তারিখ। আবার জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে তিনি বলেছিলেন, কখন নির্বাচন হবে সেটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের তিন দিন পর ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার শপথ গ্রহণ করে। এরপর জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে তিনি নির্বাচনের আগে সংস্কারের জন্য কয়েকটি কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন। সে কমিশনগুলো এর মধ্যে কাজ করতে শুরু করেছে।

তবে সংস্কার কার্যক্রম সমর্থন করলেও এ সরকারের শুরু থেকেই নির্বাচনের জন্য রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছে বিএনপি। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনের আগে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে জোর দিয়ে আসছে।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচন নিয়ে একটি রোডম্যাপ ঘোষণার আহ্বান জানালেও সরকারের দিক থেকে এ নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্য ছিলো না। বরং প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া তার ভাষণে বলেছিলেন ‘কখন নির্বাচন হবে, সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়। দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে, আপনারা কখন আমাদের ছেড়ে দেবেন। ওদিকে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রধান উপদেষ্টার সাথে সংলাপে বিএনপি আবারো নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ দাবি করে।

আলোচনা শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, নির্বাচন আমাদের এক নম্বর প্রায়োরিটি। তবে নির্বাচনের রোডম্যাপে আমরা সরকারের কাছে কোনো মাস দিনকাল নিয়ে কথা বলিনি।

কিন্তু এর মধ্যে গত মাসে রয়টার্সকে দেয়া সাক্ষাৎকারে সেনাবাহিনী প্রধান ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণ এক থেকে দেড় বছরের মধ্যেই হওয়া উচিত। তবে তিনি ধৈর্য ধারণের উপরও জোর দেন। আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন তাহলে সেটাই একটা টাইম ফ্রেম (সময়সীমা) হওয়া উচিত, যার মধ্যে একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করতে পারি বলছিলেন তিনি। মূলত বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরে শীর্ষ কারও এটাই ছিলো প্রথম নির্বাচনের একটি সম্ভাব্যসীমা উল্লেখ করা।

কিন্তু পরে সেনাপ্রধানের এ মন্তব্যকে ‘ব্যক্তিগত মতামত’ বলে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

এক সংবাদ সম্মেলনে শফিকুল বলেছিলেন, নির্বাচনের সময় নির্ভর করবে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ও তা নিয়ে রাজনৈতিক আলোচনার উপরে। তারপর সময়ের বিষয় আসবে যে নির্বাচন কবে হবে।

ওই সংবাদ সম্মেলনে সেনাপ্রধানের বক্তব্যকে তিনি নিজস্ব মতামত হিসেবে উল্লেখ করে বলেন এটা (নির্বাচন) কবে হবে? ১৬ মাস পর নাকি ১২ কিংবা ৮ মাস পরে সেটা এখনই নির্ধারিত করা যাচ্ছে না। আর আমার মনে হয় যে, সেনাপ্রধান এখানে ওপিনিয়ন দিয়েছিলেন।

পরে ভয়েস অব আমেরিকার সাথে এক সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের তারিখ সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমাদের মুখ থেকে যখন শুনবেন, সেটাই হবে তারিখ।

যা বলেছেন তারেক রহমান : নির্বাচনের তারিখ নিয়ে নতুন করে এমন বিতর্ক নিয়ে কথা বলেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের এক অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি দেয়া বক্তব্যে বলেছেন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাব্য সময় নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বিভিন্ন সময় ভিন্ন রকম বক্তব্য এসেছে।

এমন একটি কাঙ্ক্ষিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে সরকারের বক্তব্যের গড়মিল জনগণের মনে নানা ধরনের সন্দেহ সংশয়ের উদ্রেক করে। জনগণ অন্তর্বর্তী সরকারকে আরো দায়িত্বশীল গণমুখী ও কার্যকর দেখতে চায়।

তিনি বলেন, অবাধ সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ এবং জনগণের সরাসরি ভোটে একটি জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য বর্তমান সরকারের বিকল্প নেই। সে লক্ষ্যেই জনগণ বর্তমান সরকারকে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। জনগণের নিঃশর্ত সমর্থনের প্রতি নিঃশর্ত মূল্য দেয়া সরকারের দায়িত্ব।

নির্বাচনের আগে সংস্কারের জন্য সরকারি পদক্ষেপের উল্লেখ করে তারেক বলেন, সংস্কার কার্যক্রম প্রয়োজনীয় উদ্যোগ এবং তিনিও সংস্কারের পক্ষে। তবে সংস্কার একটি ধারাবাহিক ও চলমান প্রক্রিয়া। কখনো কখনো সময়সাপেক্ষ। তবে যে কোনো সংস্কারের সঙ্গে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশীদারিত্ব না হলে সেই সংস্কার কাঙ্ক্ষিত ফল দেয় না।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য জহির উদ্দিন স্বপন বলছেন, নির্বাচন নিয়ে সরকারের যে কোনো রোডম্যাপ নেই, সেটিই উঠে এসেছে সরকার সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যে।

তিনি বলেন, তারেক রহমান জনগণের সংশয়কে তুলে ধরেছেন, কারণ সরকার তাদের টার্গেট এবং নির্বাচনি রোডম্যাপ এখনো ঠিক করতে পারেনি। এ কারণেই একেকজন একেক ধরনের কথা বলছেন। আমরা মনে করি সরকারের এই অস্পষ্টতার কারণেই জনমনে উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে।

স্বপন বলেন, বিএনপি মনে করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনই হলো জনগণের আকাঙ্ক্ষা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের কাজটাই হলো জরুরি সংস্কার এগিয়ে নেয়ার পাশাপাশি নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের হাতে দেশের মালিকানা তুলে দেয়া।

গণফোরামের সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান মোস্তফা মহসীন মন্টু বলেন, সবাইকে ঐকমত্য হয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। এ সরকার জনগণের সরকার। এ সরকারকে রক্ষার স্বার্থে অর্থাৎ আমাদের নিজেদের রক্ষার স্বার্থে ভবিষ্যতে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হবে।

মন্টু বলেন, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে, এটার জন্য সার্চ কমিটি বা কিছু করার প্রয়োজন আছে, ভালো লোক নিয়োগ দেয়ার দরকার আছে। যাতে অতীতের মতো কোনো সমস্যা না হয়।

রোডম্যাপ নিয়ে তিনি বলেন, আমরা কোনো তারিখ উল্লেখ করিনি। বলেছি সংস্কার শেষে অতিদ্রুত নির্বাচন দেয়ার জন্য। তবে সংস্কার শেষ না হলে সব একই হবে। নির্বাচনের আগে থাকি রাম, নির্বাচনের পরে হই রাবণ। ওই ধরনের নির্বাচন কমিশন চাই না। অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন চাই।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আব্দুল লতিফ মাসুম বলেন, সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে দলগুলোর সাথে আলোচনা করে একটি সম্ভাব্য সময়সীমা ঘোষণা করলেই সরকার বিতর্ক এড়াতে পারত।

মনে হচ্ছে নির্বাচনের চেয়ে সরকার সংস্কারকে গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো নির্বাচনকে সামনে রেখেই সেটা হতে হবে। এজন্য দরকার ছিলো আগেই সময়সীমা সম্পর্কে এবং নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ জাতিকে অবহিত করা। সেটি না করাতেই কিছুটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

তার মতে, নির্বাচনের ব্যাপারে একটা সময়সীমা প্রকাশ করে সে অনুযায়ী এগোলে সরকারের দিক থেকেও ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য আসার সুযোগ থাকতো না বলে মনে করেন তিনি। খবর বিবিসি বাংলা।

এদিকে নির্বাচনিব্যবস্থার সংস্কারে মতামত চেয়েছেন নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার। গতকাল মঙ্গলবার এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায় নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন।

গত ৩ অক্টোবর নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। এই কমিশন অবাধ, অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সবার পরামর্শ, মতামত ও প্রস্তাবনা জানতে আগ্রহী।

প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ড. বদিউল আলম মজুমদার জানান, নির্বাচনিব্যবস্থার সংস্কার বিষয়ে সবার অভিজ্ঞতালব্ধ ও সুনির্দিষ্ট মতামত মেইল অথবা ওয়েবসাইট অথবা কমিশনের ফেসবুক পেইজে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে পাঠাতে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত