ঢাকা ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ১১ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ঢাকায় বিপদ বাড়ছে

দুর্যোগ মোকাবিলায় কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশ

দুর্যোগ মোকাবিলায় কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশ

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকা হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। চলতি বছরে কয়েকবার ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলা করতে হয়েছে বাংলাদেশকে। বিশেষ করে মে মাসে ঘূর্ণিঝড় রেমাল, আগস্টে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ আকস্মিক বন্যা এবং সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় ডানার কবলে পড়েছে বাংলাদেশ। এতে রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এসব ক্ষতিপূরণে মাঠপর্যায়ে নিয়মিত কাজ করছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।

জানা গেছে, বাংলাদেশ প্রত্যেক বছরে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, বজ্রপাত ও অসময় বৃষ্টির মুখোমুখি হচ্ছে। বন্যা কিংবা ঘূর্ণিঝড়ে ভেঙে যাওয়া রাস্তা চলাচলের উপযোগী করতে বছরে প্রয়োজনে কয়েকবার মেরামত করতে হচ্ছে। এতে সরকারের মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হয়।

দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবিলা ও জলবায়ু অভিযোজন বিষয়ে বাংলাদেশ হয়ে ওঠেছে বিশ্ব উদাহরণ। দুর্যোগযুদ্ধে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এই বাংলাদেশের মানুষের মনের জোর ও লড়াই করার শক্তি বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, পরিবেশ-বাস্তুতন্ত্র, জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং স্থলভাগে লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ সামনের দিকে আর বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বাংলাদেশ। পানি, বন, বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশ রক্ষার জন্য সর্বোত্তম অনুশীলনগুলো বের করে আনতে আঞ্চলিক পারস্পরিক সহযোগিতা জরুরি। প্রাকৃতিক আবাসস্থল এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে গবেষণা করতে হবে। নদীকেন্দ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষা করলেই পরে এ অঞ্চলের অধিকতর জলবায়ু-সহিষ্ণুতা অর্জন সম্ভব। অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত স্থিতিশীলতার জন্য নদীর গতিপথ ঠিক রাখতে হবে।

ঘূর্ণিঝড় আম্পান দেশে ফসল, অবকাঠামো ও গবাদিপশুর ব্যাপক ক্ষতি করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অনিয়মিত বৃষ্টিপাত ও খরা বাংলাদেশের ক্ষতি তীব্র করে তুলছে। আগাম ও মধ্যমৌসুমের বন্যা ভারতীয় বাঁধের উজান ও ভাটির উভয় অঞ্চলে অর্থনৈতিক, অবকাঠামোগত ও কৃষির বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। বিহার, আসাম ও বাংলাদেশের জনগণ দুর্ভাগ্যবশত একই বন্যাকেন্দ্রিক মহাদুর্যোগের শিকার। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় দুর্যোগঝুঁকি প্রশমন করা; জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার আগাম বার্তা, তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ সঠিকভাবে নিতে হবে।

বড় বড় দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ বিশ্ব উদাহরণ হলেও নগর দুর্যোগ মোকাবিলায় পিছিয়ে আছে। জলাবদ্ধতা, সড়ক দুর্ঘটনা, ভূমিকম্প আর অগ্নিকাণ্ডে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে ঢাকা। বিশ্বে অগ্নিদুর্ঘটনায় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শহর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে ঢাকা শহরকে। ভূমিকম্পসহ নগরকেন্দ্রিক বহু ঝুঁকির ক্ষেত্রে কোনো প্রস্তুতি নেই। অপরিকল্পিত নগরায়ন, বিল্ডিং কোড না মানা, ভূমিকম্প-পরবর্তী জরুরি উদ্ধার ও অনুসন্ধান কাজের অনভিজ্ঞতায় ঢাকা হয়ে ওঠছে মরণ ফাঁদ। দুর্বল ও ভঙ্গুর পদ্ধতির গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইন নগর-দুর্যোগ পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার বিশাল কার্যক্রম একই ছাতার নিচে আনতে না পারলে দুর্যোগ-পরবর্তীকালে সুষ্ঠুভাবে উদ্ধার কাজও চালানো সম্ভব হবে না। তাই এবার প্রত্যন্ত অঞ্চলের পাশাপাশি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নজর দিতে হবে নগরে। বৈশ্বিক জলবায়ুর প্রভাবে বাংলাদেশে নতুন করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়েছে। যা এখন দৃশ্যমান। জলবায়ুর পরিবর্তন স্পষ্টতই মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর প্রভাব ফেলছে। ৭০-এর পর দুর্যোগ-পরবর্তী ত্রাণ তৎপরতাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হতো। এখন সরকার দুর্যোগপূর্ব প্রস্তুতিকে গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি। এতে যে কোনো দুর্যোগে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতি অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে। দুর্যোগ মোকাবিলার বিষয়ে জলবায়ু ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ড. মঞ্জুরুল হান্নান খান বলেন, সম্প্রতি নগরে কিছু দিন পরপরই ছোট মাত্রার ভূমিকম্প হচ্ছে। বড় মাত্রার ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা আছে। বড় মাত্রার ভূমিকম্প না হলেও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু ভূমিকম্পের তেমন কোনো পূর্বাভাস ব্যবস্থা নেই।

নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. হাসিনুর রহমান বলেন, ঢাকায় জলাশয় ভড়াট করে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। বছরে প্রায় ১ লাখের বেশি বহুতল ভবন নির্মাণ হচ্ছে। এসব ভবন নির্মাণে তেমন নিয়মনীতি মানা হচ্ছে না। এতে ঢাকা শহর ঝুঁকির মুখে পড়ছে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে ফায়ার সার্ভিস আসতে আসতে ১৫-২০ মিনিট লাগছে। অনেক সময় রাস্তার অভাবে অগ্নিকাণ্ড স্থানে পৌঁছতে পারে না ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি।

ঢাকায় বহু পুরোনো ভবন, অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ, ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করা ভূমিকম্প ঝুঁকি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রমের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষিত জনবলেরও সংকট রয়েছে। নগরায়ণের দুর্যোগ মোকাবিলায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে সমন্বয় করে প্রস্ততি নিতে হবে এখনই।

প্রকৌশলী ড. সমসের আলী বলেন, শহরে আগুন, ওয়াটার লগিং, আরবান ফ্লাড, সাইক্লোন, ভূমিকম্প, ভূমিধস, বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, শব্দদূষণ থেকে শুরু করে শহরে আমাদের অনেক দুর্যোগ রয়েছে। এগুলোকে আমাদের প্রতিনিয়ত মোকাবিলা করতে হয়। আমাদের বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন অ্যাক্ট আছে। আরবান ও রিজিওনাল প্ল্যানিং অ্যাক্ট করাটা আমাদের আটকে আছে। ন্যাশনাল আরবান সেক্টর পলিসি ২০১৪ নামে আমাদের একটি খসড়া প্রস্তুত করা আছে, তবে এটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। রাজধানী ঢাকায় বড় কোনো ভূমিকম্প আঘাত হানলে প্রাণহানিসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। তাই ভূমিকম্পসহ শহরের অন্যান্য দুর্যোগ মোকাবিলায় আরও কার্যকর ও বিজ্ঞানভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রকৌশলী ড. সামসুল হুদা বলেন, বন্যা ও সাইক্লোন মোকাবিলায় অনেক এগিয়ে গেলেও নগর দুর্যোগ মোকাবিলায় পিছিয়ে। পুরোপরি সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি দেশ। ঢাকা শহরের সুউচ্চ ভবনগুলো কতটা নিরাপদ, তা কেউ জানে না। বর্ষায় সামান্য বৃষ্টিতে ঢাকার প্রধান সড়কগুলোতে হাঁটু পানি জমে।

নিমতলী, চুড়িহাট্টা, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি, বসুন্ধরা, তাজরীন গার্মেন্টের আগুন, মহাখালীর কড়াইল বস্তি, ডিএনসিসি মার্কেট, কাচ্চি ভাই বিরিয়ানী, বনানীর এফআর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ড চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে নগরকেন্দ্রিক দুর্যোগে অসহায়ত্বের চিত্র। ঢাকায় বিল্ডিং মেনে ভবন তৈরি করছেন না কেউ। অপরিবর্তিত পদ্ধতির গ্যাস লাইন, ঝুলন্ত তারে বিদ্যুৎ সংযোগ, ওয়াসার অপরিকল্পিত পানির লাইন ও সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা নগরের দুর্যোগঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় এমন অবহেলায় মৃত্যু আর ক্ষতির খতিয়ান দীর্ঘ হচ্ছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত