রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে কৌশলী বিএনপি

প্রকাশ : ২৯ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আমিরুল ইসলাম অমর

সম্প্রতি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দালিলিক প্রমাণ তার কাছে নেই বলে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের মন্তব্য ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়। এরপর তার পদত্যাগের ইস্যুটি সামনে আসে। গত মঙ্গলবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাষ্ট্রপতির পদত্যাগসহ পাঁচ দফা দাবি জানায়। একইদিন বঙ্গভবন ঘেরাও করে আরো কয়েকটি সংগঠন। পরদিন বুধবার বিএনপির তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে এসে বিএনপি নেতারা সাংবাদিকদের বলেন, এই মুহূর্তে কোনো সাংবিধানিক সংকট তৈরি হোক, সেটা তারা চান না। এরপর দৃশ্যপট পাল্টে যায় অনেকটা। রাতেই ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা জাতীয় ঐক্যের ডাক দেন। ছাত্রনেতারা ও অন্তর্বর্তী সরকার এককভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া থেকে পিছিয়ে দেশের সব রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসার কথা বলেন। অবশ্য ওইদিন রাতে ছাত্র আন্দোলনের আরেকটি দাবি মেনে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করে সরকার। সরকারের এ সিদ্ধান্তেরও সমালোচনা করেছেন বিএনপি নেতারা। গত বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর সাংবাদিকদের জানানো হয়, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি অপসারণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। এরপর রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের ইস্যু চলে যায় আলোচনার টেবিলে। সেই আলোচনায় এখন পর্যন্ত যা হয়েছে, তাতে বলা যায়, রাষ্ট্রপতির অপসারণের ক্ষেত্রে বিএনপি সাংবিধানিক সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে চাচ্ছে না। এককথায়, বিএনপি রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে কৌশলী ভূমিকা নিচ্ছে।

গত শুক্রবার জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ছাত্রনেতারা বৈঠক করেন। জামায়াত বলেছে, রাষ্ট্রপতি অপসারণে তারা নীতিগতভাবে একমত। কিন্তু এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য দরকার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতাদের সঙ্গে সংলাপে ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল ও জোট একই মতামত দিয়েছে। অর্থাৎ বিএনপির মতামত যে গুরুত্বপূর্ণ, সেটাও স্পষ্ট হয়েছে তাদের বক্তব্যে। দ্বিতীয় দফায় গত শনিবার ছাত্রনেতারা বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করেছেন। বিএনপি বলেছে, তারা দলীয় ফোরামে আলোচনা করে জানাবে। তবে দলটি ইতিমধ্যে এই ইস্যুতে গত সপ্তাহের বুধ ও বৃহস্পতিবার রাতে বিস্তারিত আলোচনা করেছে। বিএনপি মনে করে, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ফ্যাসিবাদের ‘প্রোডাক্ট’ হলেও তার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে বড় ধরনের সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হতে পারে, যা নির্বাচনকে পিছিয়ে দিতে পারে।

গত রোববার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রাষ্ট্রপতি অপসারণে কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত না নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

রাষ্ট্রপতি অপসারণে বিএনপির অবস্থান কী- এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, বিএনপির যে সর্বোচ্চ ফোরাম রয়েছে সেই ফোরামে আলোচনা হবে। আলোচনা শেষে আমাদের অবস্থান পরিষ্কার করব। মির্জা ফখরুল আরো বলেন, আমরা আগেও বলেছিলাম গণঅভ্যুত্থানের ফসল ঘরে তোলার জন্য বাংলাদেশের বিপ্লবকে সংহত করতে হয় তাহলে জাতীয় ঐক্য ও কোনো রকম হঠকারী সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না, সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় হওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি।

শেখ হাসিনার দোসর আরো অনেকেই আছে, শুধু রাষ্ট্রপতির অপসারণ ইস্যুতে কেন কেউ কেউ বেশি ব্যস্ত সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক শূন্যতা যেন সৃষ্টি না হয়, সে দিকে সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানাচ্ছি।

অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে রুহুল কবির রিজভী বলেন, আপনারা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল করেছেন, সেখানে অনেকের বিচার হবে। কিন্তু আমরা যদি কাজের বদলে অকাজে বেশি লিপ্ত হয়ে পড়ি; রাজনৈতিক শূন্যতা, সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি করি- তাহলে তো জনগণ কথা বলা শুরু করবে। বিএনপির এই নেতা আরো বলেন, আজ রাষ্ট্রপতি থাকল কি থাকল না, এটা নিয়ে আমরা দেশে কেন জটিলতা তৈরি করছি? কেন আমরা দেশে সংকট ডেকে নিয়ে আসব। এটা মুখ্য বিষয় নয়। আমরা শেখ হাসিনাকে দেশ থেকে তাড়িয়েছি, তার দোসরদেরও আইনের আওতায় নিয়ে এসে বিচার করা আমাদের দায়িত্ব।

দলটির শীর্ষ নেতারা মনে করছেন, সাংবিধানিক সংকট, রাষ্ট্রীয় সংকট, রাজনৈতিক সংকট তৈরির পেছনে কী শক্তি আছে, সেটা আগে পর্যালোচনা করা দরকার। এর আগে সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে তারা কিছু করতে নারাজ। বরং রাষ্ট্রপতি ইস্যুর চেয়ে তারা জরুরি মনে করছেন নির্বাচন অনুষ্ঠান। অর্থাৎ, নির্বাচনের তারিখ ও রোডম্যাপ ঘোষণা। রাষ্ট্রপতি ইস্যু কেন্দ্র করে অস্থিতিশীলতা কিংবা সাংবিধানিক সংকট তৈরি হলে নির্বাচন বিলম্বিত হতে পারে বলে বিএনপির নেতাদের আশঙ্কা। বিএনপি দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল। তাদের কথার বাইরে গিয়ে কিছু করলে সেটি গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে- রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে এ বিষয়টিও অন্তর্বর্তী সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের কাছে বিএনপি পরিষ্কার করতে চেয়েছে।

বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের ইস্যুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে কোনো বিরোধে জড়াবে না বিএনপি। বরং দ্রুত আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করবে। দলটির শীর্ষ মহল মনে করছে, অন্তর্বর্তী সরকার তাদের সংস্কার এবং আগামী সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ দ্রুত না দেওয়ায় একের পর এক ইস্যু নতুন করে সামনে আসছে। এতে করে নির্বাচন বিলম্বিত হচ্ছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে ইতিমধ্যে সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যদিও দলটির সিদ্ধান্ত রয়েছে, সেই ফাঁদে পা না দেয়ার এবং ছাত্র নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার। বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত ছয়টি কমিশন সংস্কারের কাজ করছে। সংস্কার ইস্যুতে বিএনপি সময় দেয়ার কথা বলছে। তবে দলটির নেতারা এটাও বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব দ্রুত সময়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ পরিচালনার ক্ষমতা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে হস্তান্তর করা। তারা আরো বলছেন, সংস্কার ও নির্বাচনি কার্যক্রম একই সঙ্গে চলতে পারে। নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপির দিক থেকে সরকারকে সবসময় চাপে রাখার সিদ্ধান্তও রয়েছে। নির্বাচনকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেই বিএনপি তার আগামী দিনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে চায়।

নির্বাচন ইস্যুতে দলটির নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় গত শুক্রবার রাজধানীর নয়াপল্টনে এক সভায় বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে মূল দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা এবং জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়া। কিন্তু মূল সমস্যা থেকে বিচ্যুত হয়ে অন্য বিষয়ের দিকে নজর দিচ্ছে তারা। তারা যা কিছু করুক, নির্বাচনের দ্রুত রূপরেখা তৈরি করুক। আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য জনগণ অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষা করবে না।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বাংলাদেশ এলডিপির প্রতিনিধি সভায় বলেছেন, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট ঘোলাটে করার জন্য একটা ‘প্রগতিশীল চক্র’ চেষ্টা করে যাচ্ছে। তার ইঙ্গিত বহন করে বঙ্গভবনের সামনে মিছিল। নতুন করে আরেকটা রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টির চক্রান্ত আমরা দেখতে পাচ্ছি।