দুই বছর আগে এই নেপালই দুহাত ভরে দিয়েছিল সাবিনা খাতুনদের। কাঠমা-ুর দশরথ স্টেডিয়ামে স্বাগতিকদের ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের মতো দক্ষিণ এশিয়ার নারী ফুটবল শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিল লাল সবুজের কন্যারা। একই আঙিনায় একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে গতকাল বুধবার আবারো শিরোপা যুদ্ধে নেমেছিল কোচ পিটার বাটলারের শিষ্যরা। এবারের যুদ্ধেও বিজয়ের মালা পড়েছেন আফঈদা-মারিয়া-তহুরা খাতুনরা। গোলশূন্য প্রথমার্ধের পর দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে মনিকা চাকমা এবং শেষদিকে ঋতুপর্ণা চাকমার গোলে সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা অক্ষুণ্ণ রাখল লাল-সবুজ জার্সিধারীরা। স্বাগতিক নেপালকে ২-১ গোলে হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করল বাংলাদেশের মেয়েরা।
এদিন স্টেডিয়ামের গ্যালারি উপচে পড়া দর্শকের নেপাল, নেপাল বলে গগণবিদারী চীৎকার। সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে স্বাগতিকদের পক্ষে যেন দ্বাদশ খেলোয়াড় হিসেবে রয়েছে হাজার পনের দর্শক। ফ্লাড লাইটের আলোতেও মুঠোফোনের আলো জ্বালিয়ে অভূতপূর্ব এক দৃশ্য তৈরি করেছে দর্শকের। এত দর্শকের চাপেও বাংলাদেশ প্রথম অর্ধে খেলেছে দুর্দান্ত ফুটবল। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে প্রথমার্ধে লড়াই হয় জম্পেশ। দুই দল জাল কাঁপানোর খুব কাছেও গেল একবার করে। কিন্তু তাদের সামনে দেয়াল হয়ে দাঁড়াল ক্রসবার। ফলে ২০২৪ সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের প্রথমার্ধ শেষ হয় গোলশূন্যভাবে। ম্যাচের প্রথম আক্রমণটি শাণায় বাংলাদেশ, দ্বিতীয় মিনিটে; কিন্তু তহুরার শট যায় বাইরে। পরের মিনিটেই আচমকা দারুণ একটা সুযোগ আসে, সেটা নষ্ট হয় ভাগ্যের ফেরে। গীতা রানা ভুল পাসে বল তুলে দিয়েছিলেন তহুরার পায়ে, তার শট ক্রসবারে প্রতিহত হয়। ফিরতি বল পেয়ে হেডে চেষ্টা করেন এই ফরোয়ার্ড, এবার গোলরক্ষকের গ্লাভসে জমে যায় বল। পরক্ষণেই সতীর্থের ব্যাকপাস ক্লিয়ার করতে গিয়ে গড়বড় করে ফেলেন বাংলাদেশ গোলরক্ষক রূপনা চাকমা, যদিও হয়নি বড় কোনো বিপদ। তবে এই চার মিনিটের খেলায় একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায়, স্নায়ুর চাপ পেয়ে বসেছে দুই দলকেই।
দশম মিনিটে ভাগ্যের ছোঁয়া পায় বাংলাদেশও। সাবিত্রার পাস ধরে বক্সের বাইরে থেকে শট নেন আমিশা কারকি, কিন্তু লাফিয়ে ওঠা রূপনাকে ফাঁকি দিয়ে বল ক্রসবার কাঁপায়। একটু পরই মাঝমাঠে এসে হঠাৎ বসে পড়েন সাবিত্রা, পরে তিনি দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে খেলা চালিয়ে যাওয়ায় স্বস্তি ফেরে স্বাগতিক শিবিরে। মাঝমাঠে আলো ছড়ানো মনিকাকে কড়া ট্যাকল করায় আমিতা জাইসিকে ম্যাচের প্রথম হলুদ কার্ড দেখান রেফারি। ২৪তম মিনিটে ডিফেন্ডার মাসুরা পারভিনের প্রায় ৪০ গজ দূর থেকে নেয়া শট পরীক্ষায় ফেলতে পারেনি আনজিলাকে। পরের মিনিটে ডানদিক থেকে আসা ক্রস লুফে নিতে ব্যর্থ হন রুপনা। সেখানে থাকা সাবিত্রা শট নেয়ার আগেই বল ক্লিয়ার করেন ডিফেন্ডার আফঈদা খন্দকার। ২৮তম মিনিটে সাবিত্রার থ্রু পাস দূরের পোস্টে ফাঁকায় পেলেও শট নিতে দেরি করেন আমিশা। শিউলি ছুটে গিয়ে বিপদমুক্ত করেন দলকে। দুই মিনিট পর গোলরক্ষক আঞ্জিলা পোস্ট ছেড়ে বেরিয়ে ফিস্ট করলে বল চলে যায় মনিকার পায়ে। তাড়াহুড়ো করে নেয়া এই মিডফিল্ডারের শট ক্রসবারের উপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। হতাশায় মুখ লুকান মনিকা। পরের মিনিটে গোলকিপারের ভুলে বক্সের বাইরে মনিকা পেয়ে ক্রসবারের অনেক ওপর দিয়ে মেরে সুযোগ হাতছাড়া করেন।
বিরতির পর খেলায় উত্তেজনা বাড়ে। আক্রমণ প্রতি আক্রমণে চলতে থাকে খেলা। গোলও আসে এই অর্ধে তিনটি। শুরুতে বাংলাদেশ এগিয়ে যায়। ৫২ মিনিটে আক্রমণ থেকে গোল আসে। সাবিনার পাসে প্রতিপক্ষের এক ডিফেন্ডার ক্লিয়ার করতে গিয়ে ডান দিকে ঠেলে দেন, সেই দেয়া বলে বক্সের ভেতরে মনিকা ডিফেন্ডারবেষ্টিত অবস্থায় আগুয়ান গোলকিপারের পাশ দিয়ে বল ঠেলে দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাতেই উৎসবে মাতে লাল সবুজ দল। চার মিনিট পর নেপাল সমতায় ফেরে। সাবিত্রা ভান্ডারির দারুণ এক পাসে আমিশা কির্কি বক্সে ঢুকে গোলকিপারের পাশ দিয়ে নিখুঁত শটে সমতা ফেরান। নিস্তব্ধ গ্যালারি জেগে ওঠে আনন্দে। এরপর আরো তিনটি আক্রমণ থেকে গোল ব্যবধান বাড়াতে পারেনি স্বাগতিকরা। ৬১ মিনিটে সাবিত্রার শট দ্বিতীয় পোস্ট দিয়ে বাইরে চলে যায়। ৬৭ মিনিটে বক্সের বাইরে থেকে মারিয়া মান্দার জোরালো শট গোলকিপার আঞ্জিলা বাঁ দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে এক হাত দিয়ে বল বাইরে পাঠিয়ে দেন। ১০ মিনিট পর রাশমির শট মাসুরার পা হয়ে গোলকিপার ঝাঁপিয়ে পড়ে লুফে নেন। দুই মিনিট পর বাংলাদেশ ম্যাচের লাগাম নিজেদের করে নিতে শুরু করে। ঋতুপর্ণার কর্নারে শামসুন্নাহার জুনিয়র ঠিকমতো লক্ষ্যে হেড নিতে পারেননি। বল মাথা ছুঁয়ে পোস্টের পাস দিয়ে চলে যায়। তবে ৮১ মিনিটে বাংলাদেশ ব্যবধান বাড়ায়। শামসুন্নাহার সিনিয়রের থ্রো ইনে ঋতুপর্ণার বাঁ পায়ের সরাসরি ভাসিয়ে দেয়া বল গোলকিপারের হাত ছুঁয়ে দ্বিতীয় পোস্টের মাঝামাঝি ভেতরের অংশে লেগে জড়িয়ে যায় জালে। স্বপ্না রানী নামেন সাবিনার জায়গায়। যোগ করা সময়ের ৫ মিনিটে কোনো দলই পারেনি গোল করতে। রেফারির শেষ বাঁশি বাজতেই বাংলাদেশের শিবিরে বাধভাঙা আনন্দ। হাজারো দর্শককে স্তব্ধ করে সাবিনা-তহুরাদের উচ্ছ্বাস ছিল দেখার মতো। গোলাম রব্বানী ছোটনের পর পিটার বাটলারও ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলেন!