আবহাওয়ার বৈরি আচরণে ঝুঁকিতে বাংলাদেশের মানুষ
প্রকাশ : ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আরিফুল ইসলাম
বিশ্বে জলবায়ু পরিপর্তনের ফলে বাংলাদেশের আবহাওয়ায় বড় পরিবর্তন এসেছে। বছরের বেশির ভাগ সময় আবহাওয়ার খেপাটে আচরনের কারণে বড় দুর্যোগ দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে। ফলে বড় ধরণের ক্ষতির মুখে পড়ছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ। তারা খতি কটিয়ে উঠতে ও হিমশিম খাচ্ছে। সূত্র জানায়, আগস্টের শেষ দিকের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ফেনীর ফুলগাজীর প্রণজিত কুমার দত্তের ঘরদোর ভেঙেছিল, দুই মাসেও তা মেরামত করে উঠতে পারেননি তিনি। চাষাবাদ করে সংসার চালানো প্রণজিত আর তার পরিবারের মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে ‘গোয়াল ঘরে’। সে ঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে আলোবাতাস আসে, চালের ছিদ্র দিয়ে পড়ে বৃষ্টির পানি।
প্রণজিত কুমারের মতো দেশের উপকূলের লাখ লাখ মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধাক্কা খেতে খেতে উদ্বাস্তু জীবন পার করছেন। শুধু গ্রাম নয় নগরেও আবহাওয়ার আগ্রাসনে ক্ষতবিক্ষত জীবন। চলতি বছর দাবদাহে পোড়া মানুষ ‘অচেনা’ এক এপ্রিলকে মনে রাখবে বহু দিন। ছকে বাঁধা জীবনের অনেক কিছুই ওলটপালট করে দেয় ‘আগ্রাসী’ এপ্রিল। আর গত আগস্ট থেকে একের পর এক আকস্মিক বন্যা, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস, অস্বাভাবিক মাত্রায় বজ্রপাত, অতি ভারী বর্ষণ, ভূমিধসের মতো একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি বাংলাদেশ। অস্থির আবহাওয়ার ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে পড়ছে শীতের আগমনি বার্তা।
শরতের পর হেমন্তেও থাবা বসিয়েছে বৃষ্টি। কমছে না উষ্ণতা। শুধু শরৎ বা হেমন্ত নয়, যেভাবে আবহাওয়ার ধরণ দিনকে দিন বদলে যাচ্ছে, তাতে আর কয়েক বছর পর বসন্তের অস্তিত্বও থাকবে কী না, তা নিয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা। আবহাওয়ার হেঁয়ালি আচরণে গ্রীষ্ম থাবা বসাচ্ছে শীতে, ঝোড়ো হাওয়া বইছে শীতে কিংবা বর্ষাকালেও ঘটছে বজ্রপাত আর শিলাবৃষ্টি। যদিও সুস্পষ্টভাবে স্থির হয়ে দেখা দিচ্ছে না নতুন কোনো ঋতুচক্র। খরার বদলে চৈত্র এখন মেঘলা আকাশ, সকালে কুয়াশা, দিনে গরম, রাতে ঠান্ডা, যখন-তখন বারিধারা। বৃষ্টি ভাঙছে অতীতের রেকর্ড। গবেষকদের মতে, আবহাওয়ার এই রূপ বদল ঘটছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে। যার প্রভাব পড়ছে জীবন ও প্রকৃতিতে। ঝুঁকিতে পড়ছে কৃষি, বাড়ছে দুর্যোগ, বাস্তুচ্যুত হচ্ছে মানুষ। নতুন নতুন রোগ মোকাবিলা করতে হচ্ছে মানুষকে।
দীর্ঘতর বর্ষাকাল : সাধারণত জুন থেকে আগস্ট বা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বর্ষাকাল ধরা হলেও এবার অক্টোবরজুড়েই ছিল মৌসুমি বায়ুর প্রভাব। সিনিয়র আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান বলেন, আগে বাংলাদেশে ছয়টি ঋতু যেভাবে বোঝা যেত, এখন আর তা বোঝা যায় না। খুব ধীরে ধীরে বড় হয়ে যাচ্ছে বর্ষাকাল। তবে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে বর্ষার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ভাদ্রের ভ্যাপসা গরম।
বাড়ছে বজ্রপাত : মুহুর্মুহু বজ্রপাত। ঝোড়ো হাওয়া। সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি। তবে কি চরিত্র পাল্টাচ্ছে বর্ষা? না হলে বর্ষায় ঘন ঘন বজ্রপাত কিছুটা অস্বাভাবিকই। আবহাওয়াবিদদের বক্তব্য, যে হারে গাছ কাটা ও দূষণ বেড়েছে, স্বাভাবিকভাবেই তার কোপ পড়েছে বর্ষা ঋতুপ্রবাহের ওপর। বজ্রপাতে চলতি বছরের শুরু থেকে ৭ অক্টোবর পর্যন্ত সরকারি হিসাবে ২৩৯ জন এবং বেসরকারি হিসাবে ৩৮২ জন মারা গেছেন। বিশ্বে বজ্রপাতে যত মানুষ মারা যান, তাদের এক-চতুর্থাংশই বাংলাদেশের।
বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, তাপমাত্রা ও বাতাসে সিসার পরিমাণ বৃদ্ধি, জনজীবনে ধাতব পদার্থ ব্যবহারের আধিক্য, মোবাইল ফোন ব্যবহার ও এর টাওয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধি, বনভূমি বা গ্রামাঞ্চলে উঁচু গাছের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস, জলাভূমি ভরাট, নদী শুকিয়ে যাওয়া ইত্যাদি বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ার কারণ। এসবের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণায়নের সম্পর্ক বেশ নিবিড়।
অস্থির হতে পারে এবারের শীতকাল : স্বভাব-শীতল শীতও কি চরিত্রবিরুদ্ধ উষ্ণতারই উপাসক হয়ে উঠছে, বদলে যাচ্ছে কোন কারণে- গত কয়েক বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে এ প্রশ্ন তুলছেন আবহাওয়াবিদ ও পরিবেশবিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, সাগরের পানি যত গরম হবে, ততই ঘূর্ণাবর্ত-নিম্নচাপ দানা বাঁধবে। ফলে শুধু শীত নয়, সামগ্রিকভাবেই বদলে যাবে ঋতুচক্রের মেজাজ। রাতের তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং শীতের বদলে যাওয়ার প্রভাব পড়ছে পরিবেশের সবখানে। বিশেষ করে শীতের ফসল এবং ফুলের পরাগমিলনে ব্যাঘাত ঘটছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে দেখা গেছে, গত ৫০ বছরে দেশের তাপমাত্রা বাড়ার হার শতকরা ০.৫। তাপমাত্রা বাড়ার এই ধারা অব্যাহত থাকলে প্রকৃতি থেকে শীত ঋতু উধাও হয়ে যাবে।
আবহাওয়াবিদ মো. শাহীনুল ইসলাম বলেন, কুয়াশা দেখা দিলেও শীত পাকাপাকিভাবে এখনই আসছে না। কয়েক দিন বৃষ্টির পর চলতি মাসের শেষের দিকে শীত পুরোপুরি শুরু হতে পারে। তিনি বলেন, ইদানিং ঢাকা শহরে যে কুয়াশা দেখা যাচ্ছে, তা ঠিক সাদা নয়, বরং কালচে রঙের। বাতাসে কার্বন ও ধূলিকণা জলীয় বাষ্পের সঙ্গে মিশে তাকে গাঢ় করে তুলছে। মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় যে ধোঁয়াশা তৈরি হচ্ছে, তার পেছনেও দূষণকে দায়ী করছেন পরিবেশবিদরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. নাজনীন আফরোজ হক বলেন, দূষণ বেশি হলে কুয়াশাও বেশি হবে।
ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা বাড়ছে : আবহাওয়া অধিদপ্তরে সংরক্ষিত ১৯৬০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেশে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়ের তালিকা ও পরের তিন বছরের ঘূর্ণিঝড়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই সময়ে মোট ৩৬টি ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে, যার মধ্যে ১৫টিই মে মাসে। চলতি অক্টোবর মাসে বঙ্গোপসাগরে একটি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হলেও তা বাংলাদেশে আঘাত করেনি। ‘জলবায়ু সেবা পরিস্থিতি ২০২০’ শীর্ষক এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্যা-সাইক্লোনসহ নানা দুর্যোগে বাংলাদেশে গত ৪০ বছরে পাঁচ লাখ ২০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনস্টিটিউট ‘ক্লাইমেট সেন্ট্রালের’ এক গবেষণায় বলা হয়েছে, আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে বন্যার আঘাতের শিকার হবে বাংলাদেশের চার কোটি ২০ লাখ মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু বন্যার ক্ষেত্রেই নয়, বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরে অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, তীব্র শৈত্যপ্রবাহ, তীব্র দাবদাহ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা, জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসও বেশি হচ্ছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, সাধারণত আগস্টে বঙ্গোপসাগরে দুই থেকে তিনটি লঘুচাপ হয়। কিন্তু এ বছর হয়েছে পাঁচটি। সেপ্টেম্বরেও স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছিল। কৃষির ক্ষতি : কৃষিবিজ্ঞানীদের অভিমত, আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনায় প্রতিবারই ফসল নষ্ট হয়। বিভ্রান্ত হন চাষিরাও। শীতের মৌসুমে জাঁকানো ঠান্ডার বদলে কখনো গুমোট আবহাওয়ায়, কখনো বৃষ্টিতে ফসলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়েছে। তাপমাত্রা বাড়ার ফলে ফসলের বৃদ্ধি যেমন মার খাচ্ছে, তেমনি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আগাছা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে বছরে বোরো ও আমন ধানের উৎপাদন ১০ শতাংশ কমে যেতে পারে। অর্থাৎ প্রায় ৪০ লাখ টন খাদ্য উৎপাদন কমতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যশোরের অভয়নগর, কেশবপুর ও মনিরামপুরে জলাবদ্ধতা হচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় ফসল ও মৎস্য সম্পদের ভবিষ্যৎ হুমকিতে পড়ছে।