সরকারের ভাবনায় আগে স্থানীয় নির্বাচন!
প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে ভাবছে সরকার। একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে এরকম তথ্য। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে দৃশ্যমান তাগাদা থাকলেও নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন। সরকারের উচ্চণ্ডপর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা কতখানি বজায় থাকে- সেই অভিজ্ঞতা ড. ইউনুসের সরকার আগেই পরখ করতে চায়। সরকারের গঠিত দুটি কমিশনের একাধিক সদস্যে জানান, সরকারের মধ্যে ইনফরমালি আলোচনা চলছে নির্বাচন আয়োজন নিয়ে। যদিও গত সোমবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে অনুষ্ঠিত কমিশনের প্রধানদের বৈঠকের পর একজন জানান, ‘সোমবার এ বিষয়ক কোনো আলোচনা হয়নি।’ তবে আরেকটি কমিশনের এক কমিশন সদস্যের ভাষ্য, স্থানীয় সরকার নির্বাচন করলে দেশে রাজনৈতিক প্রসেস বজায় থাকলো। এটা সরকারেরই সিদ্ধান্ত হতে পারে। সূত্র জানায়, নির্বাচন সংস্কার কমিশনের পর ইসি গঠনে পুরোনো পদ্ধতিকে আমলে নিয়ে সার্চ কমিটির গঠনের একটি বড় কারণ নির্বাচন নিয়ে সরকার আন্তরিক। বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের আগে পূর্ব-প্রস্ততি হিসেবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিতে পারে সরকার। এক্ষেত্রে অবশ্য দলীয় প্রতীক বাতিল করা হবে। পুলিশ সদর দফতরের একটি নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রের দাবি, ‘এরইমধ্যে সরকারের উচ্চপর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে, রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সম্মত হবে কি না, সে বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। সেটিও সরকারকে বিবেচনা করতে বলা হয়েছে। এমনকি বড় দল হিসেবে বিএনপি মানবে কি না, সে প্রসঙ্গও উত্থাপিত হয়েছে’ বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দফতরের সূত্রটি। সরকারের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে পৃথক একটি কমিশন গঠনের আলোচনা শুরু হয়েছে সরকারে। এ বিষয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসিরুদ্দীন পাটোয়ারী বলেন, আমরা এখনও নির্বাচন প্রসেস নিয়ে চিন্তা করিনি। আমরা অভ্যুত্থানে শহীদ, আহত, ক্ষতিগ্রস্তদের প্রাধান্য দিয়ে কাজ করছি। স্থানীয় সরকার বা জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এখন চিন্তা করছি না। একটি সূত্রের দাবি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চায় আগে ছাত্র সংসদগুলোতে নির্বাচন। গত সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়েছে। সে বৈঠকে চলমান বিষয়গুলোসহ নির্বাচন নিয়েও আলোচনা হয়। বৈঠকের পর স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, বৈঠকে নির্বাচনের বিষয়ে সরকারের দ্রুততম উদ্যোগ আশা করে বিএনপি। দলের নেতারা প্রকাশ্যে নির্বাচন নিয়ে দাবিও করছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে দিতে পারে, তবে বিএনপি বিরোধিতা করবে। আমি মনে করি, সরকারকে আলোচনা করেই যেতে হবে। সরকার তো আওয়ামী লীগের সরকার না। এটা তো অন্তর্বর্তী সরকার। আরেকটি দলের সভাপতি বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে আমি স্পষ্ট হতে পারিনি এখনও। তবে ধারণা করি দিতে পারে। বিএনপির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র গত সোমবার জানায়, নতুন ইসি গঠনের পর ভোটার তালিকা হালনাগাদ, নির্বাচনি আইন নিয়ে ‘নির্বাচন সংস্কার কমিশন’ এর সঙ্গে যুগপৎভাবে কার্যক্রম পরিচালনা, সংসদীয় আসন বিন্যাসের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আয়োজনে ঝুঁকবে সরকার।
গতকাল সোমবার নির্বাচন সংস্কার কমিশনের কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করেন নির্বাচন সংস্কার কমিশন প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি জানান, প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত, অনুপস্থিত ভোটারদের জন্য পোস্টাল ব্যালট, জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে ভোটার তালিকার সমন্বয়, নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অংশীদারদের সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং পরামর্শ গ্রহণ করার কার্যক্রম চলছে।
বিএনপির দলীয় একটি সূত্র জানায়, মূলত স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের মধ্যদিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বিদ্যমান সংস্কৃতি উঠে আসবে। নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান, প্রার্থী-পরীক্ষা, নির্বাচনি মাঠের বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে যাবে সরকার।
সংস্কার প্রস্তাব ও নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে সূত্র জানায়, নির্বাচন বিষয়ক সংস্কার কমিশন প্রায় সবকিছু নিয়ে কাজ করছে। জাতীয়, স্থানীয় সরকার, নির্বাচনি আইন, সংবিধানের সংস্কার বিষয়ক প্রস্তাবও দেবে নির্বাচন সংস্কার কমিশন।
এক্ষেত্রে সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাছে প্রস্তাব দিলেও ‘নতুন সংবিধান’ রচনার বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে সূত্রটি। একটি কমিশনের সূত্র জানায়, সংবিধান সংস্কার নিয়ে আলোচনার মাত্রা বাড়বে। এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে অস্থিরতার আশঙ্কাও করছেন কেউ কেউ। সংবিধান সংস্কার নিয়ে বিএনপির সিনিয়র একাধিক নেতা প্রশ্ন তুলেছেন। মঙ্গলবার এক সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘সংবিধান সংশোধন করার আপনারা কে? পার্লামেন্ট ছাড়াই সংবিধান সংশোধন করে ফেলবেন? মনে রাখতে হবে, সংবিধান কোনও রাফ খাতা না যে, যা খুশি তাই করবেন। সংবিধান সংশোধন কিংবা পুনর্লিখন করতে হলে, যারা স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছেন, যারা স্টেকহোল্ডার রয়েছেন- তাদের সঙ্গে আলোচনা করে তা করতে হবে।’
সোমবার সুপ্রিমকোর্টের মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত আইনজীবীদের এক সভায় দেশের বর্তমান সংবিধান প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. কামাল হোসেন বলেন, কোনো ব্যক্তি কলমের খোঁচা দিয়ে এটাকে (সংবিধান) বদলাবে না। একজন ব্যক্তি যদি মনে করেন, প্রেসিডেন্টও যদি মনে করেন, এটা ভুল হচ্ছে, এটা ওনার উচিত হবে না যে কলমের খোঁচায় এটাকে চেঞ্জ করে দেবেন। জনগণের মতামত ওনাকে রাখতে হবে, নিতে হবে। নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সদস্য ডা. জাহেদ উর রহমান বলেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে যে আইনে ইসি গঠন হয়েছে, এবারও সেটা দিয়েই ইসি গঠন হচ্ছে। এর দুটো কারণ, সরকার ইলেকশন প্রসেসে নিয়ে নিতে চায়। আর আমরা যখন প্রস্তাব দেবো, সেটার পর সরকার রাজনৈতিক দলগুলোসহ সবার সঙ্গে আলোচনা করবে, শেষে লম্বা প্রসেস এটা। তাহলে ইসি গঠন দেরি হয়ে যাবে অনেক, যদি আমাদের প্রস্তাব অনুযায়ী হয়। আমার ধারণা সরকার যেহেতু আন্তরিক, সে কারণে প্রিভিয়াস আইনে করছে। নির্বাচন প্রসেসের দিকে আগাচ্ছে দেশ, এই সিগন্যালও দিলো সরকার।’ উল্লেখ করেন জাহেদ উর রহমান।