আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, এমপি, পৃষ্ঠপোষক ঠিকাদার, দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা ও দলীয় নেতারা বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ বিদেশে পাচার করেছেন। গত ১৫ বছরে ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে যে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন, এর বেশিরভাগই বিদেশে পাচার করেন। বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের ফলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর দেশের ভেতরে আর্থিক, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে চরম ব্যাঘাত ঘটে। এসব নিরসনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতারা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রস্তাব করেন। সেই অনুযায়ী গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। আজ সেই অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাস সম্পন্ন হতে চললো। এতো স্বল্প সময়ে দেশের আর্থিক সংকট দূরীকরণ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে গতি ফিরছে। প্রশাসনযন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ সচিবালয়ে প্রাণ ফিরতে শুরু করেছে। মাঠ প্রশাসনে কর্মকর্তারা সামগ্রিকভাবে কার্যক্রম গুছিয়ে নিয়েছেন। পুরোদমে কাজকর্মে মনোসংযোগ দিচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের যাবতীয় কাজের স্বাভাবিক গতি ফিরছে। মানবাধিকার, অর্থনীতি, প্রশাসন, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলাসহ নানা ক্ষেত্রে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত, পদক্ষেপসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে। বিশেষ করে- সচিবালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলন, নির্যাতনের কথা বলে সংখ্যালঘু হিন্দুদের দিয়ে আন্দোলন, আনসার বিদ্রোহ, পুলিশের আন্দোলনসহ নানা পন্থায় অন্তর্বর্তী সরকারকে ফেলে দেয়ার ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করা হয়েছে। এসব ষড়যন্ত্র অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ করে দিয়েছে। তারপরও ষড়যন্ত্র থেমে নেই। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরে এবং বাইরে চক্রান্ত চলছে। তিনি এসব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে গিয়ে বহু মানুষ প্রাণ দিয়েছেন, হতাহত হয়েছেন অনেকে। সেজন্য জুলাই বিপ্লবে হতাহতদের সাহায্যে প্রধান উপদেষ্টার উদ্যোগে একটি ফাউন্ডেশন গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। এ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে জুলাই বিপ্লবে নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসাসহ তাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
সচিবালয়ে কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার এরইমধ্যে প্রশাসন, ক্রীড়াঙ্গন, জ্বালানি ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে সরকারি প্রতিটি খাতে সংস্কারের প্রক্রিয়া চলাচ্ছে। এরইমধ্যে বহু দুর্নীতবাজ কর্মকর্তাদের সচিবালয় থেকে বাইরে বদলি এবং ওএসডি করা হয়েছে।
সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি : আগামীর জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করার স্বার্থে নির্বাচন কমিশন সংস্কারের লক্ষ্যে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছে। এই কমিশন ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারের কাছে সুপারিশ উপস্থাপন করবে। সরকার গঠিত এ সার্চ কমিটি নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও অন্য চার নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য প্রতি পদের বিপরীতে দুজন ব্যক্তির নাম সুপারিশ করবে। এ সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কারের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার।
কমিশন গঠন : ছয়জন বিশিষ্ট নাগরিককে কমিশনগুলো পরিচালনা করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন এবং সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। আরও চারটি সংস্কার কমিশন গঠন করছে- স্বাস্থ্য, শ্রমিক অধিকার, নারী অধিকার ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন।
মানবাধিকার : স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে হটাতে গিয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতে যেসব ফৌজদারি মামলা হয়েছে, সেগুলো প্রত্যাহার। সন্ত্রাস দমন আইন এবং সাইবার নিরাপত্তা আইনে করা মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলাগুলো দ্রুত প্রত্যাহার। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহতের ঘটনা জাতিসংঘের মাধ্যমে তদন্তের সিদ্ধান্ত, গুমের ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠিত এবং গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করা অন্তর্বর্তী সরকারের বিরাট অর্জন। মানবাধিকার এসব কর্মকাণ্ড আগামীতে অব্যাহত থাকলে দেশের মানুষ সহজেই অন্যায়ের প্রতিকার পাবেন।
সংসদ আদালত ইসি : গত ৬ আগস্ট দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। ২ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী পদত্যাগ করেন। ১০ আগস্ট প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এবং আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতি পদত্যাগ করেন। একই দিনে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। তার আগে ৮ আগস্ট সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. আসাদুজ্জামানকে অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ৫ সেপ্টেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন পদত্যাগ করেন।
রাজনীতি : ৬ আগস্ট বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নির্বাহী আদেশে মুক্তি দেয়া হয়। ২৮ আগস্ট জামায়াতে ইসলামী ও এর অঙ্গসংগঠনকে নিষিদ্ধ করে জারি করা প্রজ্ঞাপন বাতিল করা হয়। ৫ সেপ্টেম্বর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফ্যাসিবাদী দল ও জোট পুনর্বাসনের সুযোগ পাবে না।
আর্থিক খাত ও দুর্নীতি দমন : আর্থিক খাতকে ভঙ্গুর অবস্থা থেকে টেনে তুলতে দশ ব্যাংক ও এক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। যার সুফল পাচ্ছেন মানুষ। বিশেষ করে কালো টাকা সাদা করার সুবিধা বাতিল করা, নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক হ্রাস, বিভিন্ন উপায়ে অর্থ সাশ্রয়ের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। একইসঙ্গে সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও আওয়ামীপন্থি ব্যবসায়ী, পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাদের অনেকের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা হয়। ডলারের দাম আরও বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। মোবাইলে আর্থিক সেবা নগদের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা পর্ষদ বাতিল করে প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়।
আর্থিক খাতের বিষয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগের নেতারা ব্যাংক খাতকে পরিবারতন্ত্রে রূপান্তিত করেছিল। ফলে বছরগুলোতে বাংলাদেশের আর্থিক খাত অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় নিমজ্জিত ছিল। সেই সম্পর্কে বিতর্কের অবকাশ নেই। অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড বলে খ্যাত ব্যাংকিং খাতে চর দখল চলছিল। তবে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সুশাসনের মাধ্যমে সুরক্ষা ব্যাংক খাত সংস্কার করেছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি : আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি করা হয়েছে। যার কারণে আওয়ামী লীগের পতনের পর কয়েকদিন রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে কিছুটা বিদ্যুৎ সংকট তৈরি হয়েছিল। তবে অন্তর্বর্তী সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে গুরুত্ব দেয়ায় মানুষকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়নি। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ হবে গণশুনানির মাধ্যমে, নির্বাহী আদেশে নয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের চুক্তি পর্যালোচনায় কমিটি গঠন হয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ এর আওতায় নতুন কোনো চুক্তি হবে না।