শিশু সহিংসতা বাড়ছে
প্রকাশ : ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ৪৮২ জন শিশু সহিংসতার শিকার হয়ে নিহত হয়েছে। এই সংখ্যা ২০২৩ সালের একই সময়ের চেয়ে বেশি, যখন ৪২১ জন শিশু নিহত হয়েছিল। এই উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর তথ্য থেকে, যা গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংলাপে উপস্থাপন করা হয়। আসক এবং চাইল্ড রাইটস অ্যাডভোকেসি কোয়ালিশন ইন বাংলাদেশ (সিআরএসিবি) যৌথভাবে এই সংলাপের আয়োজন করে।
শিশুদের ওপর সহিংসতা বৃদ্ধি : সিআরএসিবি, যা দেশের শীর্ষস্থানীয় ১৪টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা, শিশু অধিকার প্ল্যাটফর্ম এবং অন্যান্য সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত, শিশুদের প্রতি সহিংসতা নিয়ে একটি যৌথ সংলাপের আয়োজন করে। আসক-এর প্রজেক্ট অফিসার শান্তা ইসলাম মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। যেখানে তিনি উল্লেখ করেন যে, বিগত বছরগুলোর মতো ২০২৪ সালেও শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে। শিশু অধিকার রক্ষায় কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও সহিংসতার ঘটনাগুলোর সংখ্যা আশানুরূপভাবে কমানো সম্ভব হয়নি। বক্তারা বিশেষ করে শিশু হত্যা, শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ, অনলাইনে যৌন হয়রানির মতো সহিংসতার ঘটনাগুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, যা বাংলাদেশের শিশুদের সুরক্ষার জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
সহিংসতার ধরন এবং পরিসংখ্যান : আসক-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালের প্রথম দশ মাসে বিভিন্ন কারণে ৪৮২ জন শিশু নিহত হয়েছে। এসব কারণে শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ, অপহরণ এবং নিখোঁজের পর হত্যা অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া, শিশুদের প্রতি সহিংসতার বিভিন্ন রূপের মধ্যে ধর্ষণ, যৌন হয়রানি এবং শিক্ষক কর্তৃক শারীরিক নির্যাতন অন্যতম। বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়, ২০২৪ সালের প্রথম দশ মাসে ৩৯ জন শিশু শিক্ষক কর্তৃক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। একই সময়ে ২১৭ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়, যার মধ্যে ১৫ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছেন ৬১ জন এবং যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ৩৪ জন। শিক্ষক দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৮৫ জন শিশু এবং বলাৎকারের শিকার হয়েছেন ৩২ জন ছেলে শিশু।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও শিশুদের মৃত্যু : আসক-এর প্রাপ্ত তথ্যমতে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে ১২১ জন শিশু প্রাণ হারিয়েছে। এই পরিসংখ্যান শিশু অধিকার রক্ষার জন্য নতুনভাবে ভাবার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে। সংলাপে বক্তারা বলেন, শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং সহিংসতা রোধে সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
আইনের প্রভাব ও বাস্তবায়ন : আসক-এর প্রজেক্ট অফিসার শান্তা ইসলাম উল্লেখ করেন যে, গত কয়েক দশকে শিশু অধিকার রক্ষায় বেশ কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, কিন্তু এসব পদক্ষেপের বাস্তবায়ন এখনো যথেষ্ট কার্যকর নয়। শান্তা ইসলাম বলেন, ‘অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশু অধিকার রক্ষার পদক্ষেপগুলোর বাস্তবায়ন ঘটেনি, যার ফলে পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। কার্যকর পর্যবেক্ষণ এবং জবাবদিহিতার অভাবে এ সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।’ ২০২৪ সালের প্রথম দশ মাসে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৫৮০ জন শিশু। এ পরিসংখ্যানে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, অপহরণ এবং যৌন হয়রানি অন্তর্ভুক্ত। আগের বছরের একই সময়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছিল ৯২০ জন শিশু। এদিকে, ২০০৯ সালে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও যৌন হয়রানির ঘটনা অব্যাহতভাবে ঘটে চলেছে, যা উদ্বেগের বিষয়।
গৃহকর্মীদের সুরক্ষা নিয়ে দাবি : কোয়ালিশন মনে করে যে, গৃহকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য উপযুক্ত আইন প্রণয়ন ও সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়োজন। গৃহকর্মী শিশুদের ওপর সহিংসতা রোধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধির গুরুত্বও বক্তারা তুলে ধরেছেন। এছাড়া, শিশু অধিকার রক্ষার জন্য জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে ব্যাপক প্রচারণা চালানোর প্রয়োজন রয়েছে বলে তারা মনে করেন।
শিশু অধিকার রক্ষার জন্য সুপারিশ : বক্তারা এই সংলাপে উল্লেখ করেন যে, শিশু অধিকার রক্ষায় সুসংহত আইন প্রণয়ন এবং বিদ্যমান আইনের কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া, শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং শিক্ষার মাধ্যমে শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করারও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ২০২৪ সালের শিশু অধিকার পরিস্থিতির এই পরিসংখ্যান সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ এবং শিশু অধিকার রক্ষায় দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য। বর্তমান পরিস্থিতিতে সমাজের সব স্তরে শিশুদের প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে শক্তিশালী পদক্ষেপ গ্রহণ করা ছাড়া শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।