সশস্ত্র বাহিনী দিবস উদযাপিত
মধ্যমণি খালেদা জিয়া
* সশস্ত্র বাহিনীর বীর শহীদদের প্রতি রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার শ্রদ্ধা * দীর্ঘ একযুগ পর সেনাকুঞ্জে খালেদা জিয়া * খালেদা-ইউনূসের কুশল বিনিময় * খালেদা জিয়াকে আনতে পেরে আমরা গর্বিত : ড. ইউনূস * খালেদা জিয়াকে সম্মান জানানোয় গোটা জাতি আনন্দিত : মির্জা ফখরুল
প্রকাশ : ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী সব বীর শহীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক কমান্ডার রাষ্ট্রপতি গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় ঢাকা সেনানিবাসে শিখা অনির্বাণের বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং শহিদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করেন। এসময় সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর একটি চৌকস দল সালাম জানান এবং বিউগলে করুণ সুর বেজে ওঠে। রাষ্ট্রপ্রধান সেখানে রাখা দর্শনার্থীদের বইয়েও স্বাক্ষর করেন। এর আগে, রাষ্ট্রপতি শিখা অনির্বাণে পৌঁছালে সেখানে তিন বাহিনীর প্রধানগণ এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাকে স্বাগত জানান। এরপরে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে ঢাকা সেনানিবাসে শিখা অনির্বাণের বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন। এসময় সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর একটি চৌকস দল প্রধান উপদেষ্টাকে সালাম জানান। এসময় বিউগলে করুণ সুর বেজে ওঠে। প্রধান উপদেষ্টা সেখানে রাখা দর্শনার্থীদের বইয়েও স্বাক্ষর করেন। এর আগে শিখা অনির্বাণে পৌঁছলে সেখানে তিন বাহিনীর প্রধানগণ এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অধ্যাপক ইউনূসকে স্বাগত জানান।
দীর্ঘ একযুগ পরে সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে ঢাকা সেনানীবাসের সেনাকুঞ্জে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দেয়া এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অতিথিদের জন্য নির্ধারিত আসনে বসেন তিনি। তার পাশেই বসেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অতিথিদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে প্রধান উপদেষ্টা তার আসনে বসে বেগম খালেদা জিয়ার সাথে কুশল বিনিময় করেন। এ সময় বেগম খালেদা জিয়া ও ড. ইউনূসকে হাস্যোজ্জ্বলভাবে কথা বলতে দেখা যায়। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে ফিরোজা থেকে বের হন এবং ৪টার দিকে সেখানে পৌঁছান সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী। সবশেষ ২০১২ সালে তিনি সশস্ত্র বাহিনীর অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। আর অর্ধযুগ পর প্রকাশ্যে কোনো কর্মসূচিতে অংশ নেন বেগম খালেদা জিয়া। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সিলেট সফর করেন তিনি। সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে ২০১২ সালে সেনাকুঞ্জে গিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। ২০১৩ সালে আমন্ত্রণ পেলেও তিনি যাননি। তবে ওই সময়ে বিএনপির তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের বেশ কয়েকজন নেতা গিয়েছিলেন। এরপর আর এই দিবসে বিএনপির নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
খালেদা জিয়ার পাশাপাশি ২০০৯ সালের পর এবারই প্রথম বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এ বছর সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে মোট ২৬ জন আমন্ত্রণ পেয়েছেন। এর মধ্যে আরো রয়েছেন বিএনপি মহাসচিব, স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান এবং অন্য পদমর্যাদার সাবেক সামরিক কর্মকর্তারা।
এর আগে গত মঙ্গলবার রাতে সশস্ত্র বাহিনী দিবসে সেনাকুঞ্জের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে আমন্ত্রণ জানায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ। সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ লে. জেনারেল মিজানুর রহমান শামীম এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লে. জেনারেল এএসএম কামরুল আহসান এই আমন্ত্রণপত্র বিএনপি চেয়ারপারসনের কাছে পৌঁছে দেন। এদিন দুপুরের দিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ২৬ সিনিয়র নেতার নামে আমন্ত্রণপত্র গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে চেয়ারপারসনের একান্ত সচিব আবদুস সাত্তারের কাছে সেনা কর্মকর্তারা দিয়ে যান। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আজ বিশেষভাবে সৌভাগ্যবান এবং সম্মানীত, বাংলাদেশের তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আমাদের মাঝে উপস্থিত আছেন। একযুগ তিনি আসার সুযোগ পাননি, আজ আমরা সবাই আনন্দিত এবং গর্বিত এই সুযোগ তাকে দিতে পেরে। দীর্ঘদিনের অসুস্থতা সত্ত্বেও বিশেষ দিনে সবার সঙ্গে শরিক হওয়ার জন্য আপনাকে আবারো ধন্যবাদ। আপনার আশু রোগমুক্তি কামনা করছি।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধারা বৈষম্যহীন, শোষণহীন, কল্যাণময় এবং মুক্ত বাতাসের যে স্বপ্ন নিয়ে রাষ্ট্রকে স্বাধীন করেছিলেন, আমি তাদের সেই স্বপ্ন পূরণে অঙ্গীকারবদ্ধ। আমরা এখন থেকে বাংলাদেশকে এমনভাবে গড়তে চাই যেখানে সত্যিকার অর্থে জনগণই হবে সকল ক্ষমতার মালিক।
ড. ইউনূস বলেন, জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে আমরা নতুন বাংলাদেশের সূচনা করেছি। এ নতুন দেশে আমাদের দায়িত্ব সকল মানুষকে এক বৃহত্তর পরিবারের বন্ধনে আবদ্ধ করা। কেউ কারো উপরে নয়, আবার কেউ কারো নিচেও নয়; এই ধারণা আমরা আমাদের জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে সেনাকুঞ্জে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে যে সম্মান জানিয়েছে তাতে গোটা জাতি আনন্দিত বলে মন্তব্য করেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘পরিকল্পিতভাবে ১২ বছর ধরে সশস্ত্র বাহিনী থেকে বেগম খালেদা জিয়াকে দূরে রাখা হয়েছিল। ‘বেগম খালেদা জিয়া তার জীবনের বড় সময়টা দিয়েছেন দেশের গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য। তাকে (খালেদা জিয়া) পরিকল্পিতভাবে ১২ বছর ধরে দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনী থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। আমন্ত্রণ জানিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে যে সম্মান দেয়া হয়েছে, এতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনী প্রধানের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। আমি আজকে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের বিশেষ করে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান এবং বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁনকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। এবং বিশেষ করে আমাদের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে যে তিনি আজকে ম্যাডামকে (খালেদা জিয়া) যে সম্মান দেখিয়েছেন, এতে আমরা যেমন কৃতজ্ঞ হয়েছি, একই সঙ্গে গোটা জাতি আজকে আনন্দিত হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানিয়েছে, বেগম খালেদা জিয়া সেনাকুঞ্জে পৌঁছালে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান এবং বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন তাকে অভ্যর্থনা জানান। এর আগে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে বেগম খালেদা জিয়া গুলশানের বাসভবন ‘ফিরোজা’ থেকে সেনাকুঞ্জের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের উদ্দেশে রওনা হন। ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান তার সঙ্গে ছিলেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, বেগম খালেদা জিয়া সেনাকুঞ্জে পৌঁছে তার আসনে বসার পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। আগেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে পৌঁছান বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বেগম খালেদা জিয়াকে অনুষ্ঠানে দেখে তিনি কেঁদে ফেলেন। সেনাকুঞ্জের অনুষ্ঠানে বিএনপি নেতাদের মধ্যে আরো উপস্থিত ছিলেন- বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ, আব্দুল মঈন খান, এ জেড এম জাহিদ হোসেন, ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী, খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা পরিষদের ফজলে এলাহী আকবর, বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল, বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস, খালেদা জিয়ার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা একেএম শাসমুল ইসলাম প্রমুখ। এবার সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির ২৬ নেতাকে সেনাকুঞ্জে আমন্ত্রণপত্র জানানো হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সমন্বয়ে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী গঠিত হয় এবং তারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর সর্বাত্মক হামলা চালায়। স্বাধীনতার পর থেকে এই ঐতিহাসিক দিনটিকে প্রতিবছর যথাযোগ্য মর্যাদায় সশস্ত্র বাহিনী দিবস হিসেবে পালন করা হয়।