ভয়াবহ রূপে এডিস মশা

প্রকাশ : ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আমিরুল ইসলাম অমর

দিনদিন রাজধানীসহ সারাদেশে ভয়াবহ রুপ নিচ্ছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। এডিস মশাবাহী ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে আরো ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৮৮৬ জন। এতে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪৮ জনে। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুম থেকে পাঠানো ডেঙ্গুবিষয়ক এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়াদের মধ্যে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ৩৭৩ জন এবং বাকিরা ঢাকার বাইরের। এ সময়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন ৯৩৮ জন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৮৫ হাজার ৭১২ জন। এর মধ্যে ছাড়পত্র পেয়েছেন ৮১ হাজার ৪৫৬ জন। মারা গেছেন ৪৪৮ জন। প্রতি বছর বর্ষাকালে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। ২০২৩ সালের জুন মাস থেকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। গেল বছর দেশে ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন। এর মধ্যে ঢাকায় ১ লাখ ১০ হাজার ৮ জন এবং ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নিয়েছেন ২ লাখ ১১ হাজার ১৭১ জন। আক্রান্তদের মধ্যে হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন ৩ লাখ ১৮ হাজার ৭৪৯ জন।

গত বছর ১ হাজার ৭০৫ জন মশাবাহিত এই রোগে মারা গেছেন, যা দেশের ইতিহাসে এক বছরে সর্বোচ্চ মৃত্যু। এর আগে ২০১৯ সালে দেশব্যাপী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন। ওই সময় চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীসহ প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল।

চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশে ৪২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৮০ হাজার মানুষ। আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা এতই বেশি যে তাদের চিকিৎসা দিতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো।

গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে ডেঙ্গু কেড়ে নিয়েছিল ১ হাজার ৭০৫ জনের প্রাণ। যা এক বছরে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড। যেখানে ২০২২ সালে ২৮১ জন আর ২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছিল ১৭৯ জনের। এতে বোঝা যাচ্ছে গত কয়েক বছরে ব্যাপক বিস্তারসহ ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।

কেন এত মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন : গবেষণা বলছে জলবায়ু পরিবর্তন এর অন্যতম কারণ। দেখা যাচ্ছে বর্ষাকালের বেশিরভাগ দিন শুষ্ক থাকছে। তবে যখন বৃষ্টি হচ্ছে, তখন ব্যাপক ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। এতে করে জমে থাকা পানি দীর্ঘদিন অবস্থান করছে। যা ডেঙ্গুবাহী মশার বিস্তারে ভূমিকা রাখছে। ধারণা করা হচ্ছে, এ বিষয়টি এবারের ডেঙ্গু প্রকট আকার ধারণ করায় ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশে বর্ষা ঋতুর পরিবর্তন এখন স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। আগে বর্ষাকাল থাকত জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত। কিন্তু এখন এটি পরিবর্তন হয়ে বর্ষাকাল জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত থাকছে।

এমনকি এক দশক আগেও বর্ষা মৌসুমে হাল্কা বৃষ্টি, ভারী বৃষ্টি এবং নির্দিষ্ট ভারী বৃষ্টিপাত হতো। কিন্তু এখনকার বর্ষার মৌসুমে বৃষ্টির দিনের সংখ্যা কমে গেছে। কিন্তু যখন বৃষ্টি হচ্ছে- তা আগের যে অনেক গুণ বেশি হচ্ছে। আর কম সময়ের মধ্যে অতিরিক্ত বৃষ্টি হওয়ার অর্থ হলো পানি জমে যাচ্ছে। বাজে ড্রেনেজ সিস্টেম এই অবস্থা আরও খারাপ করেছে।

বিশেষ করে শহুরে এলাকায় এটি খারাপ প্রভাব ফেলেছে। আগে শুধুমাত্র বর্ষার মৌসুমে বৃষ্টি হওয়ায় ডেঙ্গুর বিস্তার ওই নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকত। কিন্তু এখন যেহেতু বৃষ্টির দিনের সময় বেড়েছে তাই সারাবছরই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। এছাড়া এটি বিশ্বব্যাপী একটি মহামারিতে পরিণত হওয়ার শঙ্কাও বাড়ছে। ডেঙ্গু জ্বরের কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। এ কারণে প্রতিরোধই এই রোগ থেকে বাঁচার সবচেয়ে বড় উৎকৃষ্ট উপায়। শুধু বাংলাদেশে নয় বিশ্বব্যাপী বেড়েছে ডেঙ্গু। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে যত মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছেন তার ৭০ শতাংশই এশিয়ার। সংস্থাটি আরো জানিয়েছে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশা নিধনে ব্যবহৃত কীটনাশকে কার্যকরী উপাদান নির্দিষ্ট মাত্রায় থাকলে সুফল পাওয়া যেত। যেহেতু সুফল মিলছে না, তাই এই কীটনাশক কীটতত্ত্ববিদদের উপস্থিতিতে ল্যাবে পরীক্ষা ও মান যাচাই করতে হবে। তৃতীয় পক্ষ থেকে আবার মনিটরিংয়েরও তাগিদ তাদের।

দুই সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে দুই সিটিতে মশা নিধনে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫৪ কোটি টাকা। ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে (ডিএসসিসি) ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বরাদ্দ ৪৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে মশা নিধনে কীটনাশক কিনতে ৪০ কোটি টাকা ব্যয় রাখা হয়।

মশা নিধনে চলতি অর্থবছরে প্রায় ১১০ কোটি টাকা বরাদ্দ ঢাকা উত্তর সিটিতে (ডিএনসিসি)। এর মধ্যে মশা নিধনে কীটনাশক কিনতে রাখা হয় ৬৫ কোটি টাকা। বাকি অর্থ ফগার, হুইল, স্প্রে মেশিন ও পরিবহন, ব্লিচিং পাউডার ও জীবাণুনাশক এবং মশা নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রপাতি কিনতে বরাদ্দ রাখা হয়। গত ১৩ বছরে ঢাকার মশা নিধনের নানা পদক্ষেপের পেছনে খরচ হয়েছে এক হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা।

উভয় কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা জানান, ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর ও টেকসই সমাধানে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে গঠিত ছয় সদস্যের দুটি পৃথক বিশেষজ্ঞ কমিটি কাজ করছে। বিশেষজ্ঞরা স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের সঙ্গে মশাবাহিত রোগের ওপর একটি পৃথক জরিপ পরিচালনার পাশাপাশি কীটনাশকের মানসম্মত ডোজ ব্যবহার নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছেন।

কীটতত্ত্ববিদরা মনে করেন, মনিটরিং ব্যবস্থায়ও গাফিলতি আছে। যারা মনিটর করছেন, তাদের কার্যক্রম মনিটরিংয়ের জন্য পৃথক টিম থাকা দরকার। এ ছাড়া মনিটরিংয়ের কাজে শিক্ষার্থীদের যুক্ত করতে হবে। একদল শিক্ষার্থীর মনিটরিংয়ের পর আরেকদল গিয়ে তা মনিটর করতে হবে, যাতে মনিটরিংয়ের কার্যক্রমে কোনো ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ না থাকে। যেখানে মশা বা লার্ভা বেশি পাওয়া যাচ্ছে, তার আশপাশের এলাকার মানুষকে সচেতন করার জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকায় কর্মশালার আয়োজন করতে হবে, যাতে স্থানীয়রা সচেতন হয়।

জানা যায়, চলতি বছরে ঢাকায় দুই সিটি কর্পোরেশনে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এখন পর্যন্ত ৩ লাখ ২৬ হাজার ৪৭২ টি স্থাপনা পরিদর্শন করা হয়। যেখানে লার্ভা পাওয়া গেছে ৭ হাজার ১৯৫টি স্থাপন। প্রজনন স্থল ধ্বংস ও লার্ভিসাইড স্প্রে করা হয়েছে ৪ লাখ ১০ হাজার ৩০৭ টি স্থাপনায়। মশক নিধনে স্প্রে করা হয়েছে ৩৭ হাজার ৫০৫টি নোভালিউরন ট্যাবলেট প্রয়োগ করা হয়েছে। তবুও কেন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন নগরবাসী এর কোনো সঠিক জবাব দিতে পারছে না দুই সিটির সংশ্লিষ্ট বিভাগ।

নগরবাসীর অভিযোগ, প্রতিবছর নগরীতে এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এ বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে মাঝেমধ্যে অভিযান পরিচালনা করা হলেও কাজের কাজ তেমন কিছুই হচ্ছে না। তবে কোন বাড়িতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে সেখানে ওষুধ ছিটানোসহ নানা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। কিন্তু আমরা চাই প্রতিটি এলাকার বাড়িতে এভাবে ওষুধ ছিটানো হোক। তাহলে পুরোপুরি ডেঙ্গুমুক্ত হবে নগরী।