উত্তরের জেলা পঞ্চগড়সহ রংপুর, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারী ও লালমনিরহাটে শীতের আগমন জোরালোভাবে অনুভূত হচ্ছে। তাপমাত্রার দ্রুত পতনে উত্তরাঞ্চলে শীতের প্রকোপ বেড়েই চলেছে। সবশেষ পঞ্চগড়ে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে মাত্র ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অন্য জেলার তাপমাত্রাও ১৪ থেকে ১৬ ডিগ্রির মধ্যে অবস্থান করছে। শীতের এই তীব্রতা কেবল আবহাওয়ার পরিবর্তন নয় বরং কৃষি, জনস্বাস্থ্য এবং অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। কৃষকরা ফসল রক্ষা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, আর হতদরিদ্ররা শীতবস্ত্র সংকটে বিপর্যস্ত।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এ বছর উত্তরাঞ্চলে স্বাভাবিকের তুলনায় তীব্র শীতের আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষত ডিসেম্বরের শেষ ভাগ থেকে জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত বেশ কয়েকটি শৈত্যপ্রবাহ আঘাত হানতে পারে। রংপুর আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা আবু সাঈদ বলেন, এবার শীতের তীব্রতা বেশ বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সীমান্তবর্তী এলাকা এবং নিচু জমির আশপাশে ঠান্ডা বাতাস ও ঘন কুয়াশা আরো বাড়বে, যা জীবনযাত্রা এবং কৃষি খাতে চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। দিনাজপুরের চাষি আনোয়ার হোসেন জানান, ঘন কুয়াশায় আলুর পাতায় দাগ পড়েছে। জমিতে বেশি আর্দ্রতা থাকায় গমের চারা সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারছে না। সবজি ক্ষেতেও পোকা-মাকড় ও রোগের প্রকোপ বেড়েছে।
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া থেকে কৃষক রমিজ উদ্দিন বলেন, সরিষার ফুল ঝরে পড়ছে। উৎপাদন কম হলে লোকসান হবে। কীটনাশক দিয়ে লাভ হচ্ছে না। কুয়াশা এত বেশি যে সব সময় জমি ভিজে থাকে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ইতোমধ্যে ফসল রক্ষার জন্য কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। জমিতে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা এবং প্রয়োজনীয় কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে বলা হচ্ছে। তবে স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ- এসব পদ্ধতিতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে, যা তাদের পক্ষে বহন করা কঠিন। শীতের কারণে উত্তরাঞ্চলে শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া এবং সর্দি-কাশির প্রকোপ বাড়ছে। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা বেশি ঝুঁকির মুখে। গ্রামীণ এলাকায় চিকিৎসাসেবার পরিস্থিতি আরো কঠিন করে তুলছে।
ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালের চিকিৎসক শফিকুল ইসলাম জানান, প্রতিদিন হাসপাতালে শিশু ও বয়স্ক রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তাদের বেশিরভাগই শ্বাসকষ্ট এবং ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত। তীব্র শীতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন উত্তরাঞ্চলের শীত মোকাবিলায় ও ফসল রক্ষায় কৃষকদের আরও কার্যকর প্রশিক্ষণ এবং সাশ্রয়ী মূল্যে কীটনাশক সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। প্রত্যন্ত এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা দ্রুত পৌঁছে দেয়া এবং ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প পরিচালনা করার পরিকল্পনা করলে ভালো হবে।
এদিকে পাবনা প্রতিনিধি জানায়, দিন বদল ও আধুনিকতার আশীর্বাদে হারিয়ে যেতে বসেছে পালপাড়ার সেই রমরমা অবস্থা। এক সময় মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিল, থালা-বাসন, ঘটি, মটকা, সরা, কাসা, কলস, ব্যাংক, প্রদীপ, পুতুল, কলকি ও ঝাঝরের বিকল্প ছিল না। তবে আধুনিকতার ছোঁয়া আর মানুষের রুচির পরিবর্তনে মাটির তৈরি সামগ্রীর স্থান দখল করে নিয়েছে প্লাস্টিক, মেলামাইন, স্টিল আর অ্যালুমিনিয়ামের নানা সামগ্রী। তাই বাজারে চাহিদা কম এবং কাঁচামালের চড়া মূল্য আর পুঁজির অভাবে টিকতে না পারায় সংকটে পড়েছে পাবনার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পীরা। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বাঁচতে পারে এ শিল্প।
মৃৎশিল্পীরা জানান, ব্যবহারিক জীবনে এখন মৃৎশিল্পের তেমন আর ভূমিকা নেই। এ শিল্পে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সাধিত না হওয়ায় বর্তমানে এই পেশায় টিকে থাকা অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি চাটমোহর উপজেলার নিমাইচড়া ইউনিয়নের গৌড়িপুর পালপাড়ায় গেলে দেখা যায়, ভোরের আলো ফুটতেই মাটির হাঁড়ি-পাতিল তৈরি করে রোদে শুকাতে দিচ্ছে কুমাররা, কেউ বা ব্যস্ত সময় পার করছেন বিভিন্ন সামগ্রী তৈরিতে, কেউ বা করছেন রং এভাবেই সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চলছে তাদের কর্মব্যস্ততা। পালপাড়ার মায়া রাণী বলেন, দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে এ কাজ করি। আগে মাটির সামগ্রীর প্রচুর চাহিদা থাকলেও এখন আর তেমন নেই। শীত মৌসুমে পিঠাপুলির সামগ্রী তৈরি করেই কোনোমতে চলে সংসার। তিনি জানান, এমনিতেই ব্যবসা চলে কম তার ওপর নেই রাস্তাঘাট তাই গৌড়িপুর পালপাড়া থেকে নিমাইচড়া বাজার পর্যন্ত পাকা সড়কের দাবি জানান তিনি।
কাঁচামাটির পাত্র পুড়িয়ে পরিণত করতে ব্যস্ত দুলাল পাল। এ ব্যস্ততার ফাঁকে তিনি বলেন, প্রায় ৪০ বছর ধরে বাপ-দাদার শেখানো পেশায় কাজ করছি। আগের দিনে বাজারে মৃৎপাত্রের প্রচুর চাহিদা থাকলেও এখন অনেকটাই কম। অন্য কাজ জানা নেই তাই এ পেশাই আঁকড়ে ধরে আছি।
দুলাল পাল জানান, পেশাগত প্রয়োজনে ব্যাংক ঋণ পান না তারা। সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ পেলে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর যাবে বলে জানান তিনি। স্থানীয় মৃৎশিল্পীরা মনে করেন, ঐতিহ্যবাহী এই মৃৎশিল্পকে বাঁচাতে সরকারের বহুমুখী উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ খুবই প্রয়োজন। এ ব্যাপারে বিকাশ পাল, সম্বল পাল, দরদী পাল ও সুবর্ণা পাল জানান, এক সময়ে এই গ্রামে মৃৎশিল্পের রমরমা ব্যবসা ছিল। আগে গৌড়িপুর গ্রামে প্রায় ১১০ ঘর মৃৎশিল্পের কাজ করতো। কিন্তু এখন ১০-১৫ ঘরে প্রায় ৩০-৩৫ জন পাল এ কাজের জড়িত। তারা বলেন, এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।