মুক্ত আলোচনায় বক্তারা

পুলিশের সঙ্গে সব বিভাগের সংস্কার করতে হবে

প্রকাশ : ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

পুলিশ সংস্কারের পাশাপাশি সরকার, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সব বিভাগের সংস্কার করতে হবে। এছাড়া শুধু পুলিশ সংস্কার সম্ভব নয় বলে মনে করেন আলোচকরা। ‘৫৩ বছরেও পুলিশ কোনো জনবান্ধব হতে পারেনি, পুলিশ সংস্কার, কেন, কোন পথে?’ শিরোনামে এক মুক্ত আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন। গতকাল শনিবার দুপুরে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে স্বেচ্ছাসেবী মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন এই মুক্ত আলোচনার আয়োজন করে।

অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ উপনিবেশিক আইরিশ ফসট্রিকুলারীর উত্তরসূরী। উৎপীড়ন, বিরোধী মত দমন, ক্ষমতাসীনদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন ও ক্ষমতার অপব্যবহারে পুলিশ গঠন করা হয়েছিল। পুলিশ বাহিনী চলছে ব্রিটিশ আইনে। ফলে পুলিশ আজও জনগণের কাঙ্ক্ষিত ও গণতান্ত্রিক দেশের উপযোগী হিসেবে গড়ে ওঠেনি। জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে দেখা গেছে, পুলিশ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হওয়ার পরিবর্তে সরকার তথা রাজনৈতিক হিসেবে পুলিশকে ব্যবহার করায় জনরোষের শিকার হতে হয়েছে। পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থা কমেছে। পুলিশি ব্যবস্থার সংস্কার ও ঐকমত্য সৃষ্টি, সংস্কারের যৌক্তিকতা এবং সংস্কার কমিশন গঠন করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বক্তারা বলেন, কোনও একটি গোষ্ঠীর দাবি বা উদ্যোগের ফলে পুলিশ সংস্কার করা প্রায় অসম্ভব। তাই পুলিশ সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও জনমতের ঐকমত্য হবে হবে। কেননা, এর আগেও একাধিকবার পুলিশ সংস্কারের প্রস্তাব করা হয়েছিল।

শুধুমাত্র ঐকমত্য না থাকায় তা বাস্তাবায়ন করা সম্ভব হয়নি। তাই পুলিশ বাহিনীর আইনের প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করার সময় পুলিশের অনাকাঙ্ক্ষিত বল প্রয়োগ, বিরোধী মত দমন, বেআইনিভাবে আটক এবং জনগণকে সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার মতো যত অভিযোগই উঠুক না কেন- কাঠামোগত আইনি সংস্কার না হলে পুলিশের দুর্নীতিবাজদের জন্য জনগণকে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে না।

পুলিশের হারানো মনোবল পুনরুদ্ধার করার জন্য আইনি ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার বিবেচনায় সংস্কার করা সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। তাই পুলিশের সংস্কার সরকারের কাছে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনিই জনগণের সার্বিক নিরাপত্তা, অপরাধ দমন, অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ। একইসঙ্গে পুলিশ সংস্কার ও পুলিশের কার্যক্রম দেখাভালে মনিটরিং কমিশন থাকতে হবে।

অনুষ্ঠানে প্রধান আলোচক হিসেবে পুলিশের সাবেক আইজি মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, পুলিশের সব কিছু ভেঙে পড়েছে। পুলিশে মিলিটারাইজেশনের ফলে কী ক্ষতি হয়েছে সেটা সবাই দেখছেন। এখন পুলিশে মিলিটারি ব্রেন ডুকে পড়েছে। এজন্য পুলিশে সংস্কার জরুরি। পলিটিক্যাল ভিশন না থাকলে কোনও সংস্কারই কার্যকর হবে না। তাছাড়া জনগণকে সম্পৃক্ত করে পুলিশিং করলে বড় সংখ্যক পুলিশের প্রয়োজন হবে না। তাছাড়া অন্য বাহিনী থেকে পুলিশের কোনও ইউনিটে কাউকে আনলে তাকে অন্তত ৬ মাস পুলিশিং এর প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

তিনি আরো বলেন, আমাদের মতো বিভাজিত সমাজে পুলিশিং কঠিনবিষয়। পুলিশ পাবলিক সার্ভেন্ট থেকে ডমিস্টিক সার্ভেন্ট হয়ে গেছে।

পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য গোলাম রসুল বলেন, পুলিশ সংস্কারের বিষয়ে এর আগে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদেক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। আমরা গত ২ মাস ধরে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করছি। কেমন পুলিশ হবে, সে বিষয়ে জনগণের মতামতকে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। আমরা মিডিয়া এবং বিভিন্ন মাধ্যমে জরিপ চালাচ্ছি। সেখানে জনসাধারণের মন্তব্যকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, আমরা যে জিনিসটাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি, সেটা হচ্ছে জাতীয় জননিরাপত্তা কমিশন গঠন করা। এটি একটি স্থায়ী কমিশন হবে, এটির একটি সচিবালয় থাকবে এবং এটির একটি গবেষণাগার থাকবে। রাজনৈতিক ব্যক্তি, সিভিল সোসাইটির নিয়ে সম্মিলিতভাবে এটি গঠন করা হবে। এজন্য বিদ্যমান আইন এবং যেসব অসঙ্গতি রয়েছে, সেগুলো রিভিউ করে সুনির্দিষ্টভাবে সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হবে।

সুপ্রিমকোর্টের সাবেক রেজিস্ট্রার ও সাবেক জেলা জজ ইকতেদার আহমেদ বলেন, পুলিশ সম্পর্কে আমাদের সংবিধানেও আইনে বলা হচ্ছে পুলিশ ডিসিপ্লিন ফোর্স, ল এনফোর্সমেন্ট এজেন্সি ও সিভিল ফোর্স। সমস্যাটা আসলে এখানে যে, পুলিশ কি সিভিল ফোর্স নাকি ল এনফোর্সমেন্ট এজেন্সি, নাকি ডিসিপ্লিন ফোর্স। কেননা, এই তিনটির কার্যক্রম একেক ধরনের। আবার নিয়োগ ও পদন্নতিতেও রয়েছে ভিন্নটা। কেননা, যার আইজি হওয়ার কথা, তিনি আইজিপি হচ্ছে না। ফলে এসব জায়গা ঠিক করা জরুরি। একইসঙ্গে শুধু পুলিশ বাহিনীকে সংস্কার করলে হবে না। তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব বিভাগের সংস্কার করতে হবে। বিশেষ করে পুলিশের এনফোর্সমেন্ট বিভাগে, তদন্ত বিভাগে এবং বিচার বিভাগের শৃঙ্খলা আসলে জনমানুষের কাছে পুলিশ একটি আদর্শ বাহিনীতের রূপ নিতে পারে।

পুলিশের সাবেক ডিআইজি মেজবাউন্নবী বলেন, ভালো পুলিশ পেতে হলে ভালো শাসক দরকার। এই ছাত্র আন্দোলনের পর আমার মনে হয়- ভালো পুলিশ পাওয়ার এটাই শেষ সুযোগ। বারবার এমন সুযোগ আসবে না। র‍্যাব যখন শুরু হয়েছে, তখন থেকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছে। মনে চাইলো আর একটা বাহিনী বানিয়ে ফেললাম সেটা হবে না। যার ৬ দিনের ট্রেনিংও নাই, সেও এই বাহিনীতে পুলিশিং করছে। এই জিনিসটা পুরোটাই রাজনীতিকেন্দ্রিক হয়েছে।

মুক্ত আলোচনা অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি ও আইন বিভাগের শিক্ষার্থী সাঈদ আব্দুল্লাহ বলেন, পুলিশ সংস্কারে প্রধানত তিনটি জায়গা ঠিক করা প্রয়োজন। চাকরি বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। একজন পুলিশ সদস্য যদি বাড়ি-ঘর ও জায়গা-জমি বিক্রি করে ১৫ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরিতে যোগ দেন। তাহলে তিনি যেভাবেই হোক তার সেই টাকা তুলতে অন্যায় পথ বেছে নেবেন। একইসঙ্গে পুলিশ বাহিনীকে রাজনীতি-বলয়মুক্ত করতে হবে। ফলে একটি থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসিকে না দিয়ে থানার দায়িত্ব একজন বিসিএস ক্যাডারকে দিতে হবে। আর ওসিকে সেই বিসিএস ক্যাডারের সহযোগী হিসেবে রাখাতে হবে। কেননা, ওসি বিভিন্নভাবে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হতে পারে। এছাড়া পুলিশকে সার্ভিস বাহিনীতে রূপান্তর করা জরুরি। এজন্য একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করতে হবে। হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ শফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে আরো বক্তব্য রাখেন- পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য পুলিশের সাবেক উপমহাপরিদর্শক গোলাম রসুল, সুপ্রিমকোর্টের সাবেক রেজিস্ট্রার ও সাবেক জেলা জজ ইকতেদার আহমেদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম, গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির ভিসি ড. আনিসুজ্জামান, আইসিটি ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির কো-অর্ডিনেটর সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মাজহারুল হক, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ এর কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা মনির হোসাইন কাসেমী, পুলিশের সাবেক ডিআইজি মেসবাহুন নবী, সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজ ইয়াসমিন গফুর, ফ্রন্ট পেজের সম্পাদক সেলিম খান, সাংবাদিক আহমেদ সেলিম রেজা, আইনের শিক্ষক ড. আহমেদুজ্জামান, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের নেত্রী জাকিয়া শিশির, হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. পারভেজ এবং তারুণ্যের প্রতিনিধি সাইদ আবদুল্লাহ, সাবেক পুলিশ কন্সটেবল মান্নানসহ আারো অনেকে।