স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকার সবকিছু ধ্বংস করে গেছে। ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়তে শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। দেশের অর্থনীতি, শাসনব্যবস্থা, আমলাতন্ত্র ও বিচারব্যবস্থায় সর্বাত্মক সংস্কারে নজর দিয়েছে। টেকসই রাষ্ট্র সংস্কারের পাশাপাশি বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্যভুক্ত ২৭ দেশ ও ঢাকায় ইইউ মিশনের প্রধানসহ ২৮ রাষ্ট্রদূত ঢাকায় সমবেতভাবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করছেন। যা, বাংলাদেশের ইতিহাসে ঐতিহাসিক ঘটনা। এর আগে বাংলাদেশের ইতিহাসে ২৮ দেশের রাষ্ট্রদূত একযোগে কোনো সরকারপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক করতে ঢাকায় আসেননি।
জানা গেছে, ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে এ বিশাল সংখ্যক রাষ্ট্রদূত একসঙ্গে বৈঠক করতে ঢাকায় আসছেন। এবার কাজটি করার পেছনে আছে ইইউয়ের সমর্থন প্রকাশ করা এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উচ্চ পর্যায়ের সহযোগিতা গড়ে তোলা।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের সংকটময় সময়ে রাষ্ট্রদূতরা হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। বিশাল সংখ্যক রাষ্ট্রদূত একসঙ্গে বৈঠকে ঢাকায় কখনো আসেনি। এবার কাজটি করার পেছনে আছে ইইউর সমর্থন প্রকাশ করা এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উচ্চ পর্যায়ের সহযোগিতা গড়ে তোলা। এরইমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করেছেন সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ব্রাজিল, তুরস্ক, রাশিয়া, ফিনল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, লিবিয়াসহ অনেক দেশের রাষ্ট্রদূত। দ্বিপাক্ষিক নানা সহযোগিতাসহ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির আশ্বাস এসেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি ব্যাপক আন্তর্জাতিক সমর্থনকে সরকারের সার্বিক কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে অভিহিত করেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেন, দায়িত্ব গ্রহণ করার পর, আমরা সব দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যাপক ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি। প্রফেসর ইউনূসের বৈশ্বিক মর্যাদা বাংলাদেশের কূটনৈতিক ভাবমূর্তিকে শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাকে আন্তর্জাতিক মহলের সাদরে স্বাগত জানানোই এর প্রমাণ। তৌহিদ বলেন, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার উদ্যোগ ব্যাপকভাবে সমর্থিত হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক অর্জনগুলোর মধ্যে একটি হলো আগস্ট-জুলাই মাসে বাংলাদেশে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানের সাথে মিলিত প্রতিবাদে অংশ নেয়ার জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) আটক শতাধিক বাংলাদেশি প্রবাসীকে মুক্তি দেয়া। প্রাথমিকভাবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ফেডারেল আদালতে এদের দীর্ঘ কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল। পরে প্রধান উপদেষ্টা ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মধ্যে সরাসরি আলোচনাসহ উচ্চণ্ডস্তরের কূটনৈতিক যোগাযোগের পর, বন্দিদের ক্ষমা করে দেশে পাঠানো হয়। এ ঘটনাকে বিশ্বে অধ্যাপক ইউনূসের সুখ্যাতি ও সরকারের কৌশলগত যোগাযোগ এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে এ বিক্ষোভ হয়েছে বলে সে দেশের সরকারকে বোঝানোর প্রচেষ্টাকে কৃতিত্ব দিয়ে তৌহিদ বলেন, এ ধরনের ঘটনা নজিরবিহীন। প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যে বৈঠককে একটি মাইলফলক। ৩০ বছরের মধ্যে দুই দেশের নেতাদের মধ্যে প্রথম উচ্চণ্ডপর্যায়ের বৈঠক ছিল, এটি। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ফাঁকে বাংলাদেশ সরকারপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে তার দেশের পূর্ণ সমর্থন দেয়।
গত বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মোহাম্মদ রফিকুল আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ইইউর ২৭টি দেশের রাষ্ট্রদূত (২০ জন অনাবাসী রাষ্ট্রদূতসহ) এবং ইইউর রাষ্ট্রদূতসহ মোট ২৮ জন কূটনীতিক সম্মিলিতভাবে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ইইউর সব সদস্যরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত একত্র হয়ে সরকারপ্রধানের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগটি এবারই প্রথম। এ উদ্যোগ বাংলাদেশ ও ইইউর সম্পর্ক আরো সুসংহত করবে।
মুখপাত্র বলেন, বৈঠকে বাংলাদেশের সঙ্গে ইইউভুক্ত সদস্যরাষ্ট্রগুলো এবং ইইউর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সার্বিক পর্যালোচনা, সহযোগিতার নতুন ও সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র, এলডিসি উত্তরণ পরবর্তী জিএসপি প্লাস বাণিজ্য সুবিধাদি, জলবায়ু পরিবর্তন সৃষ্ট অস্তিত্ব সংকট মোকাবিলা, দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বাস্তবায়ন এবং সর্বোপরি একটি টেকসই ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে উভয়ের অঙ্গীকার ও করণীয় সম্পর্কে আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকাবস্থায় দেশের ভেতরে লুট, দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, বিচারব্যবস্থা ও আইনশৃঙ্খলাসহ প্রত্যেকটি সেক্টর অবনতির চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। আওয়ামী লীগের স্বৈরশাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই নামত অত্যাচারের খড়গ। সেই খড়গ থেকে জনগণকে রেহাই দিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন। আর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকতে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। এতে হাজারের বেশি মানুষ নিহত হন এবং আহত হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। এর আগে ১৭ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, দিল্লি থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২০ দেশের রাষ্ট্রদূত এবং ইইউ মিশনের প্রধান ঢাকায় আসছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেয়ার পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যাপক সমর্থন পাওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি আরো বলেছিলেন, কয়েক দিনের মধ্যে দিল্লিতে থাকা ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২০ দেশের রাষ্ট্রদূত ও ঢাকায় আছেন সাত দেশের সাত রাষ্ট্রদূত এবং ইইউ মিশনের প্রধানসহ মোট ২৮ রাষ্ট্রদূত একযোগে তার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন, যা বাংলাদেশে আগে কখনো ঘটেনি। সমর্থন ও সহযোগিতার জন্য বিশ্ব নেতাদের ধন্যবাদ দিয়ে ওই সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, আমি যখন সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেই, সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, কানাডা, ইতালি, হল্যান্ড, জাতিসংঘ মহাসচিবসহ বিশ্বের অনেক দেশের সরকারপ্রধানের সঙ্গে আমার বৈঠক করার সুযোগ হয়। তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদের প্রতি সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। নেপাল, মালদ্বীপ, পাকিস্তানসহ প্রতিবেশী বেশ কয়েকটি দেশের সরকারপ্রধানের সঙ্গেও আমার বৈঠক হয়েছে যেখানে আমি সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার কথা বলেছি।