বিদ্রোহীদের তড়িৎগতির আন্দোলনের মুখে সিরিয়ার সংঘাতে জড়িত সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনার পর প্রেসিডেন্টের পদ থেকে পদত্যাগ ও সিরিয়া ছেড়ে চলে গেছেন বাশার আল-আসাদ। তবে সিরিয়া ছাড়ার আগে নিজ গন্তব্য সম্পর্কে কাউকে কোনো তথ্য জানাননি তিনি। গতকাল রোববার রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার বিষয়ে এই তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের নির্দেশ দেয়ার পর প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ত্যাগ করেছেন বাশার আল-আসাদ।’ সিরিয়ার এই প্রেসিডেন্ট বর্তমানে কোথায় রয়েছেন, সেই বিষয়ে বিবৃতিতে কোনো তথ্য জানায়নি রাশিয়া। বিবৃতিতে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, বাশার আল-আসাদের দেশ ত্যাগের বিষয়ে আলোচনায় অংশ নেয়নি রাশিয়া। তবে তিনি দেশ ছেড়েছেন। মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘বাশার আল-আসাদ ও সিরীয় আরব প্রজাতন্ত্রের ভূখণ্ডে সশস্ত্র সংঘাতে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে আলোচনার ফল হিসেবে তিনি প্রেসিডেন্টের পদ থেকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের নির্দেশনা দিয়ে দেশ ত্যাগ করেন।’
সিরিয়ায় রাশিয়ার সামরিক সব ঘাঁটিকে উচ্চ সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে। বর্তমানে রুশ কোনো ঘাঁটিতে গুরুতর হুমকি নেই। রাশিয়া বলেছে, সিরিয়ার সব বিরোধীদলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে মস্কো। একই সঙ্গে সব পক্ষকে সহিংসতা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে।
সিরিয়ার ইসলামপন্থি সশস্ত্র গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) নেতৃত্বে দুই সপ্তাহের কম সময়ের এক অভিযানে গতকাল রোববার পতন ঘটেছে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদের। এদিন বিদ্রোহীরা দামেস্কে ঢুকে পড়ায় প্রাণ বাঁচাতে বিমানে করে পালিয়ে গেছেন তিনি। তবে তার গন্তব্য জানা না গেলেও সিরিয়ার দুটি নিরাপত্তা সূত্র রয়টার্সকে বলেছে, প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বিমান দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। গতকাল রোববার সিরিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশনে দেয়া এক ঘোষণায় এইচটিএস বলেছে, ‘স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদকে সিরিয়ার ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা হয়েছে। সব সিরীয় আজ মুক্ত এবং স্বাধীন। সিরিয়া দীর্ঘজীবী হোক।’ এদিকে, বিদ্রোহীরা সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ অধ্যায়ের অবসান ঘোষণা করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। বিদ্রোহীরা শহরের প্রাণকেন্দ্রে ঢুকে পড়ার সময় ব্যক্তিগত একটি বিমানে চড়ে দেশ ছাড়েন বাশার-আল আসাদ। কিন্তু বর্তমানে তিনি কোথায় রয়েছেন, সেই বিষয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। এরইমধ্যে তার মৃত্যুর আশঙ্কার কথা জানিয়েছে ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা রয়টার্স।
সিরিয়ার দুটি নিরাপত্তা সূত্রের বরাত দিয়ে রয়টার্স বলেছে, প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বিমান দুর্ঘটনার মারা যাওয়ার উচ্চ সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ দামেস্ক থেকে তাকে বহনকারী বিমানটি উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পর উপকূলীয় এলাকায় গিয়ে অনেকটা আকস্মিকভাবে দিক পরিবর্তন করে। বিমানের এই দিক পরিবর্তন নিয়ে রহস্য তৈরি হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে বিমানের চলাচল পর্যবেক্ষণকারী ওয়েবসাইট ফ্লাইটরাডার বলছে, আসাদকে বহনকারী বিমানটি সিরিয়ার মানচিত্র থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
ফ্লাইটরাডারের তথ্য অনুযায়ী, বিদ্রোহীরা সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের দখল নেয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পরপরই একটি বিমান দামেস্ক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়ন করেছে। বিমানটি প্রাথমিকভাবে সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলের দিকে উড়েছিল। ওই অঞ্চলটিতে আসাদণ্ডসমর্থিত আলাউইত সম্প্রদায়ের শক্ত ঘাঁটি রয়েছে। কিন্তু সেখানকার আকাশে পৌঁছানোর পর আকস্মিক ইউ-টার্ন নেয় বিমানটি। এরপর কয়েক মিনিটের জন্য বিপরীত দিকে উড়ে যায় এবং কিছুক্ষণ পর মানচিত্র থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় বিমানটি।
তবে দামেস্ক থেকে উড্ডয়ন করা ওই বিমানে প্রেসিডেন্ট বাশার-আল আসাদ ছিলেন কি না তা তাতক্ষণিকভাবে নিশ্চিত হতে পারেনি রয়টার্স। যদিও সিরিয়ার নিরাপত্তা সূত্র রয়টার্সকে বলেছে, প্রেসিডেন্ট আসাদের বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। তার বিমানটি কেন আকস্মিক ইউটার্ন নিয়েছে, সেটি ঘিরে রহস্য তৈরি হয়েছে। সিরিয়ার লৌহশাসক বাশার আল-আসাদের পতনের সাথে সাথে দেশজুড়ে আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠেছেন লাখ লাখ মানুষ। দেশটির প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ গাজী আল জালালি সিরিয়ায় অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এই নির্বাচনের মাধ্যমে সিরীয় নাগরিকরা তাদের নেতা বেছে নেবেন।
জালালি বলেছেন, দেশের এই ক্রান্তিকাল অতিক্রমের জন্য তিনি বিদ্রোহী কমান্ডার ইসলামপন্থি সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) প্রধান আবু মোহাম্মদ আল-জোলানির সাথে আলোচনার জন্য যোগাযোগ করেছেন। যা দেশটির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ গঠনের প্রচেষ্টায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। প্রেসিডেন্ট বাশার-আল আসাদের পাশাপাশি তার সন্তান ও ক্যানসার আক্রান্ত স্ত্রী আসমা কোথায় রয়েছেন, তা এখনও জানা যায়নি। তবে সিরিয়ার এই প্রেসিডেন্ট মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে পৌঁছেছেন বলে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়লেও আমিরাতের প্রেসিডেন্টের কূটনৈতিক উপদেষ্টা আনোয়ার গারগাশ বলেছেন, আসাদ সংযুক্ত আরব আমিরাতে আছেন কি না, তা তিনি জানেন না। বাহরাইনের মানামা সংলাপে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আনোয়ার গারগাশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে আসাদ আশ্রয় নিতে পারেন এমন জল্পনার বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি অস্বীকৃতি জানান। তিনি বলেন, ‘লোকজন জানতে চাইছেন, বাশার আল-আসাদ কোথায় যাচ্ছেন? সত্যিই দিনের শেষে এটি ইতিহাসের একটি পাদটীকা। আমি এটিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না। যেমনটা আমি বলেছি, শেষ পর্যন্ত এটি বড় ঘটনার এক পাদটীকা।’