ঢাকা ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ভারতবিরোধী শক্ত অবস্থানে বিএনপি

ভারতবিরোধী শক্ত অবস্থানে বিএনপি

৫ আগস্ট স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশে নানাভাবে বিশৃঙ্খলার ষড়যন্ত্র চলছে। যেখানে ভারত নানাভাবে জড়িত বলে মনে করা হচ্ছে। এমনকি বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক হামলা-নির্যাতনের তেমন কোনো ঘটনা না ঘটলেও বিশ্বে তা ভিন্নভাবে প্রচার করছে ভারতীয় গণমাধ্যম। দেশটির সরকারের বক্তব্য-বিবৃতি উসকানিমূলক বলেও পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। দলটির নীতিনির্ধারকদের মতে, বিএনপি বড় রাজনৈতিক দল হিসাবে বিশ্বাস করে দেশপ্রেম সবার আগে। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে জনগণ যা চায় তাই করবে।

বিএনপির নীতিনির্ধারকরা বলছেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরও ভারত তাদের অবস্থান বদলায়নি। আর এ কারণেই বাংলাদেশের জনগণও ক্ষুব্ধ। পার্শ্ববর্তী দেশ হিসাবে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক হওয়া উচিত পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে। বিএনপিও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক চায়। কিন্তু ভারতের কর্মকাণ্ডে মনে হচ্ছে সে দেশের সরকার বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক না রেখে একটি বিশেষ দলের সঙ্গে সম্পর্ক অব্যাহত রেখেছে। এই নীতিকে ‘একচোখা’ নীতি মনে করে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন তারা (নীতিনির্ধারক)। তাই দেশটির (ভারত) আগের নীতি পরিবর্তন চান তারা। বাংলাদেশের জনগণ কী চায় তার ভিত্তিতে ভারতের অবস্থান হওয়া উচিত বলেও মনে করছেন নেতারা। সম্প্রতি বিএনপির একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে নেতাদের পর্যবেক্ষণ ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

এদিকে, গত রোববার ভারতীয় দূতাবাস অভিমুখে পদযাত্রা করে স্মারকলিপি দিয়েছে বিএনপির তিন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন। সেখানে মানুষের ঢল নামে। এছাড়া বাংলাদেশের দূতাবাসে হামলা, পতাকা অবমাননা, ভারতের মিডিয়ায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চলমান তথ্য সন্ত্রাস এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে আজ বুধবার ঢাকা থেকে আগরতলা অভিমুখে (আখাউড়া সীমান্ত পর্যন্ত) লংমার্চ করবে বিএনপির তিন অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল। গত সোমবার সকালে রাজধানীর নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিন সংগঠনের পক্ষে যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি আব্দুল মোনায়েম মুন্না এ কর্মসূচির ঘোষণা দেন। আজ সকাল ৮টায় নয়াপল্টন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে শান্তিপূর্ণভাবে লংমার্চ শুরু হবে। নয়াপল্টন থেকে গাড়িবহর নিয়ে আগরতলার এপারে আখাউড়া সীমান্ত পর্যন্ত যাবেন নেতাকর্মীরা। পথিমধ্যে বিভিন্ন জেলার নেতাকর্মীরা যোগ দেবেন। আখাউড়ায় একটি সমাবেশ করার কথা রয়েছে।

আজ বুধবার ভারতের আগরতলা অভিমুখে (ঢাকা টু আখাউড়া) লংমার্চ করবে বিএনপির তিন অঙ্গসংগঠন জাতীয়তাবাদী যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল। লংমার্চকে কেন্দ্র করেও ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে সংগঠন তিনটি। প্রাথমিকভাবে দলটির এই তিন সংগঠন ভারতবিরোধী কর্মসূচি দিয়েছে, এ ধরনের কর্মসূচি সামনে আরো আসবে বলে জানা গেছে। বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মতে, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ভারতের সঙ্গে তাদের দলের সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা দৃশ্যত ব্যর্থ হওয়ায় তারা আরও শক্ত ও প্রকাশ্যে ভারতবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছেন। জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে, বিশেষ করে ভারতীয় রাজনীতিবিদ ও গণমাধ্যমের ব্যাপক বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচার এবং উসকানিমূলক বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের দলকে এই অবস্থান নিতে হয়েছে বলে দাবি করছেন তারা।

বিএনপি নেতারা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা পালিয়ে সেখানে আশ্রয় নেয়ায় বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং জনগণ বিশ্বাস করে ভারত ধর্ম কার্ড ব্যবহারসহ বিভিন্নভাবে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে।

বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আমাদের একটা পররাষ্ট্রনীতি আছে। আমরা বলেছি, সব দেশের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব কিন্তু কোনো প্রভুত্ব নয়। শুধু ভারতের সঙ্গে নয়, পুরো বিশ্বের সঙ্গে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি থাকতে হবে। ছোট-বড় দেশ বলে কোনো কথা নেই। ভারত যদি বাংলাদেশের মানুষের মনোভাব না বোঝে, তাহলে দুই দেশের সম্পর্ক হবে মুখোমুখি। আজ তারা নেপালের সঙ্গে বন্ধুত্ব হারিয়েছে, মালদ্বীপের সঙ্গেও হারিয়েছে, এমনকি ভুটানের সঙ্গেও বন্ধুত্ব হারিয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক অনেক আগেই হারিয়েছে। এখন বাংলাদেশের সঙ্গে। তাদের ভাবতে হবে দক্ষিণ এশিয়ার ভেতর সবগুলো দেশের সঙ্গে সম্পর্ক হারিয়ে তারা কীভাবে চলবে। কোনো দেশই ভারতের সঙ্গে আপস করছে না। ভারতের অবস্থা বাঘ ও শিয়ালের গল্পের মতো হয়ে গেছে।

বিএনপির নেতারা বলছেন, বিএনপি একদিকে যেমন ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক পর্যায়ে বন্ধুত্ব চায়, অন্যদিকে তাদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধেও সোচ্চার থাকবে। আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে সহিংস ঘটনার সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নীরব ভূমিকায় ছিল, যা ওই ঘটনার পেছনে কর্তৃপক্ষের মৌন সম্মতিকে ইঙ্গিত করে। ভারত সরকার চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে ভিয়েনা কনভেনশনের বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী কূটনীতিকদের সুরক্ষা দিতে। এছাড়া ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কতিপয় নেতা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি নিজেও বাংলাদেশে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর কথা বলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের অবমাননা করেছেন। জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর ভারতের মিডিয়া বাংলাদেশের বিরুদ্ধে লাগামহীন প্রোপাগাণ্ডা ছড়াচ্ছে। গণঅভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে গঠিত ছাত্র-জনতার সরকারকে বিব্রত করার উদ্দেশ্যে তারা ক্রমাগত ভিত্তিহীন এবং কল্পনাপ্রসূত খবর প্রচার করছে। তাদের অপপ্রচার এবং গুজবের কারণে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, যা একই সঙ্গে ভারতের সংবিধানের ৫৫ অনুচ্ছেদের পরিপন্থি।

জানা যায়, একজন হিন্দুধর্মীয় নেতাকে গ্রেফতারের পর ভারতের হিন্দুত্ববাদী কিছু সংগঠন ও গোষ্ঠী সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ তুলে আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে হামলা চালায়, পতাকা আবমাননা করে। এ নিয়ে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে দলমত-নির্বিশেষে সবাইকে এক জায়গায় আনার উদ্যোগ নেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। পতিত আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্ররা ছাড়া দেশের সব রাজনৈতিক দল, সংগঠন এবং বিভিন্ন ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টার ঐক্যের ডাকে বিএনপি সাড়া দিয়ে এখন মাঠের কর্মসূচিও দিচ্ছে। এর মধ্যেই গত সোমবার ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি ঢাকা সফর করেন। বিকালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পর ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সাংবাদিকদের বলেন, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে গঠনমূলক ও ইতিবাচকভাবে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চায়। এজন্য দুই দেশের জনগণের স্বার্থে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে আগ্রহী দিল্লি।

জানা গেছে, গত সংসদ নির্বাচনের আগ থেকে বিএনপির ভারতবিরোধী মনোভাব বাড়তে থাকে। কিন্তু এই ইস্যুতে কোনো কর্মসূচিতে যায়নি দলটি। ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দুই পক্ষের এক ধরনের সমঝোতা হতে পারে- এমন গুঞ্জন শোনা গেলেও বাস্তবে সে ধরনের কোনো কিছু দেখা যায়নি। বিএনপির তিন সংগঠনে ভারতীয় দূতাবাস অভিমুখে পদযাত্রা ও স্মরকলিপি এবং লংমার্চ করে বিএনপি দেশটিকে এক ধরনের সতর্কবার্তা দিতে চাইছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত