ঢাকা ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আয়নাঘরের স্বীকারোক্তি র‌্যাবের

গুম-খুনের জন্য ক্ষমা চাইলেন মহাপরিচালক

গুম-খুনের জন্য ক্ষমা চাইলেন মহাপরিচালক

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দপ্তরে গোপন নির্যাতন কেন্দ্র থাকার কথা এবং গুম-খুনের অভিযোগ স্বীকার করে নিয়েছেন বাহিনীর মহাপরিচালক একেএম শহিদুর রহমান। ‘গুম তদন্ত কমিশনের’ নির্দেশে ‘আয়নাঘর’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া সেসব গোপন নির্যাতন কেন্দ্র ‘অপরিবর্তিত অবস্থায়’ রাখার কথা বলেছেন তিনি। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকার কারওয়ানবাজার র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ বাহিনীর বিরুদ্ধে থাকা বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন র‌্যাব প্রধান। বিভিন্ন সময়ে র‌্যাবের বিরুদ্ধে গুম-খুনের যেসব অভিযোগ উঠেছে, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে তার বিচারের প্রত্যাশা জানিয়ে ভুক্তভোগীদের পরিবারের কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন তিনি। শহিদুর রহমান বলেন, ‘যত ধরনের অভিযোগ আছে, গুমের বিষয়ে, খুনের বিষয়ে, আয়নাঘরের বিষয়ে, এটা গুম-খুন কমিশন তদন্ত করছে। আমরা তাদের সার্বিকভাবে এ তদন্তে সহায়তা করছি। আমরা আশা করব, এ তদন্তের ফলাফলের ভিত্তিতে একটা আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ র‌্যাবে ‘আয়নাঘর’ ছিল কি না জানতে চাইলে মহাপরিচালক বলেন, ‘র‌্যাবে যে আয়নাঘরের বিষয়টা এসেছে, এটা তো ছিল, আছে। কমিশন আমাদের নির্দেশ দিয়েছে যে, সেটা যে অবস্থায় আছে ওই অবস্থায় রাখার জন্য। কোথাও এখন কোনোরকম যেন পরিবর্তন, পরিবর্ধন না করা হয়। সে অনুযায়ী আমরা ঠিক ওইভাবেই রেখেছি, যা যেভাবে ছিল।’ আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বিরোধী মতের বহু মানুষকে তুলে নিয়ে বিচারবহির্ভূতভাবে অজ্ঞাত স্থানে আটক রাখার অভিযোগ ওঠে, সেসব বন্দিশালাকে প্রতীকী হিসেবে ‘আয়নাঘর’ নাম দেয়া হয়েছে। তুলে নেয়া সেই সব মানুষদের কেউ কেউ বহু দিন পর পরিবারের কাছে ফিরে বীভৎস নির্যাতনের বিবরণ দিলেও অনেকেরই এখনো খোঁজ মেলেনি।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ‘গুমের’ ঘটনা তদন্তে গত ২৭ আগস্ট অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের ‘গুম তদন্ত কমিশন’ গঠন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কমিশনে যত অভিযোগ পড়েছে, তার বেশিরভাগই পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট র‌্যাবের বিরুদ্ধে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ তুলে এরইমধ্যে র‌্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ করেছে বিএনপি, যদিও ২০০৪ সালে তাদের সরকারের সময়ই এ বাহিনী প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। পুলিশ সংস্কার কমিটির কাছে জমা দেয়া সুপারিশমালা তুলে ধরতে গিয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ১০ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘র‌্যাব বাহিনী আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দিত হয়েছে। আর দেশের মধ্যে তো র‌্যাব মানেই একটা দানব সৃষ্টি করেছে। তারা যত ধরনের খুন-গুম, যত এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিং অধিকাংশই এই র‌্যাব বাহিনীর মাধ্যমে হয়েছে। সেজন্য আমরা এটিকে বিলুপ্ত করার সুপারিশ করেছি।’ এরপর গতকাল বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে র‌্যাবের মহাপরিচালক ভবিষ্যতে ‘আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে’ তার বাহিনীর দায়িত্ব পালনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন, ‘র‌্যাবের বিরুদ্ধে বেশকিছু অভিযোগ আছে। গুম-খুন, অপহরণ, এ ধরনের বেশকিছু অভিযোগ আমাদের বিরুদ্ধে আছে। আপনাদের মাধ্যমে দেশবাসীকে জানাতে চাই, আজ পর্যন্ত যে সমস্ত জনগণের যারা র‌্যাব দ্বারা, নির্যাতিত বা অত্যাচারিত হয়েছে, তাদের কাছে এবং যারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে, যেমন নারায়ণগঞ্জের সাত খুনসহ যারা র‌্যাব কর্তৃক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে, তাদের পরিবারের কাছে আমরা দুঃখ প্রকাশ করি এবং ক্ষমা প্রার্থনা করি। পাশাপাশি সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এ সমস্ত ঘটনার বিচারের প্রত্যাশা রেখে তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গুম-খুন কমিশন করেছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ ধরনের অপরাধ আমলে নিয়ে বিচারকাজ পরিচালনা করছেন। আমরা আশা করব, আমাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আছে, তার সুষ্ঠু তদন্ত হবে এবং এর বিচার হবে। এভাবেই দায়মুক্তি সম্ভব, অন্য কোনোভাবেই আমরা এ দায় থেকে মুক্ত হতে পারব না। কেবলমাত্র সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচারের মাধ্যমেই আমরা দায়মুক্ত হতে চাই। আমি আপনাদের মাধ্যমে আবারো যারা র‌্যাবের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন তাদের পরিবারের, তাদের কাছে আবারো দুঃখপ্রকাশ এবং ক্ষমা প্রার্থনা করছি। গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ২০২১ সালের ডিসেম্বর র‌্যাব এবং এর সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের অনুরোধ জানানো হলেও যুক্তরাষ্ট্রের সাড়া মেলেনি। যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই বলে আসছে, নিষেধাজ্ঞা উঠানোর প্রক্রিয়া বেশ ‘জটিল’। র‌্যাব বিলুপ্তির বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বাহিনীর প্রধান বলেন, ‘আমি র‌্যাবে কর্মরত আছি। আমরা যতদিন র‌্যাবে দায়িত্ব পালন করব, আমাদের দায়িত্ব আমরা নিষ্ঠার সঙ্গে আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করব। এ ব্যাপারে সরকার যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, সেটাই শিরোধার্য। আমরা সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকব। র‌্যাবের পোশাক পরিবর্তন চান কি না- এ প্রশ্নে একেএম শহিদুর রহমান বলেন, ‘পুলিশের ক্ষেত্রে দাবি উঠেছে, র‌্যাবের ক্ষেত্রেও দাবি উঠেছে। আমরা পোশাক পরিবর্তনের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করছি। আমি মনে করি পোশাকের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে মানুষটাকে পোশাক পরানো হয় তারা। ভালো ব্যক্তি যে পোশাকই পরুক না কেন তার কাছ থেকে আমরা ভালো কিছু পাব, খারাপ ব্যক্তিকে যত ভালো পোশাকই পরাই, আমরা ভালো কিছু পাব না। র‌্যাবের নিজস্ব আইন প্রণয়নের বিষয়ে ভাবা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘র‌্যাবের নির্দিষ্ট কোনো আইন নাই। পুলিশ ব্যাটালিয়ন আইন সংশোধন করে র‌্যাব বাহিনী গঠন করা হয়েছে। আমরা র‌্যাবের জন্য একটা আইন প্রণয়নের চিন্তা করছি। এছাড়া, কীভাবে সংস্কার আনা যায় জনসাধারণের মতামত সাপেক্ষে আমরা পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’ আন্দোলনে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হেলিকপ্টারের বিষয়ে মহামান্য হাইকোর্টের যে রিট আছে, এ সংক্রান্ত ফৌজদারি মামলাও রুজু হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এটার অনুসন্ধান করছে। আমরা আশা করব এ সংক্রান্ত অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য বের হয়ে আসবে। এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করা হবে।’ আন্দোলনে অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ পর্যন্ত ভিডিও দেখে দুই হাতে দুইটা পিস্তল নিয়ে গুলি করছিল পাবনায়, তাকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। যাত্রাবাড়ী এলাকায় লিটন নামে একজন ছিলেন, তাকেও আমরা গ্রেপ্তার করেছি। এ পর্যন্ত মোট ৩০ জনকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। আরও যারা আছে, গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।’ র‌্যাব সদস্যদের ছিনতাই-ডাকাতির মতো বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মহাপরিচালক বলেন, ‘এ পর্যন্ত ছিনতাই-ডাকাতি-চাঁদাবাজির সাথে সম্পৃক্ত জড়িত ১৬ জন র‌্যাব সদস্যকে আটক করে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি চার্জ দায়ের করেছি। ভবিষ্যতেও কোনো সদস্য এ ধরনের অপরাধ করলে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা এবং বিভাগীয় মামলা দুটোই অব্যাহত থাকবে। এ বিষয়ে আমরা কঠোর অবস্থানে আছি। নারায়ণঞ্জে ত্বকী হত্যাকাণ্ডের তদন্তে ‘যথেষ্ট অগ্রগতি’ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত ৫ জন গ্রেপ্তার হয়েছিল, তাদের দুইজন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছিল। ৫ আগস্টের পরে আরো ৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে একজন জবানবন্দি দিয়েছে। আশা করছি মামলার তদন্ত দ্রুত সম্পন্ন করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সক্ষম হবো।’ বগুড়ায় মাকে হত্যার দায়ে সন্তানকে অভিযুক্ত করা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শহিদুর রহমান বলেন, ‘কাজ করতে গেলে কিছু ভুলভ্রান্তি হয়, কাজ না করলে ভুল হয় না। এক্ষেত্রে যাতে ভুলভ্রান্তি না হয়, ভবিষ্যতে সতর্ক থাকব। বগুড়ার ওই ঘটনায় পেশাদারিত্বের পরিচয় না দেয়ার কারণে ওই অফিসারের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। তদন্তের পর পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ গত ১০ নভেম্বর বগুড়ায় গৃহবধূ উম্মে সালমা খাতুনের (৫০) লাশ বাড়িতে থাকা ডিপফ্রিজের ভিতরে পাওয়ার ঘটনায় পরদিন তার ছেলে সাদ বিন আজিজুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

গতকাল সকালে র‌্যাব-১২ বগুড়ার কোম্পানি কমান্ডার মেজর মো. এহতেশামুল হক খান নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘হাত খরচের টাকা এবং প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে মনোমালিন্যের জেরেই’ মাকে হত্যার পর লাশ ডিপ ফ্রিজে রাখেন সাদ। পরে পুলিশি তদন্তে সাদ বিন আজিজুরের সম্পৃক্ততা না থাকার কথা উঠে এলে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনায় পড়ে র‌্যাব। মহাপরিচালক জানান, গণঅভ্যুত্থানের সময় র‌্যাবের ১৬৮টি অস্ত্র খোয়া গিয়েছিল, যার মধ্যে ৯০টি উদ্ধার হয়েছে। আর লুট হওয়া ১২ হাজার গুলির মধ্যে ৭ হাজার উদ্ধার সম্ভব হয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে জড়িতদের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে র‌্যাব প্রধান বলেন, এখন পর্যন্ত ৪ জন সাবেক মন্ত্রী, ১৭ জন সাবেক এমপি, সাবেক মেয়র/উপজেলা/ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ৪০ জন, কাউন্সিলর/মেম্বার ১৬ জন, আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের ১৮৩ জন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ছবি ও ভিডিও ফুটেজ ও সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনার মাধ্যমে চিহ্নিত করে ৩০ জন সরাসরি গুলিবর্ষণকারীসহ সর্বমোট ৩৫৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত