ভোটের প্রস্তুতি শুরু ইসির
প্রকাশ : ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আরিফুল ইসলাম
আগামী সংসদ নির্বাচনের জন্য সবধরনের প্রস্তুতি শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে আগামী বছর বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করে নতুন তালিকা দিয়ে সংসদ ভোট করতে গেলে ২০২৬ শুরুতে ভোট করতে পারবে না ইসি। এ কারণে বিদ্যমান ভোটার তালিকা দিয়ে ভোট করতে হবে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটিকে। এতে করে অর্ধকোটিরও বেশি ভোটার হওয়ার উপযোগী বাংলাদেশি নাগরিক বাদ পড়ে যাবে। বিশেষ করে জুলাইয়ের আন্দোলনের অনেক শিক্ষার্থী ভোট দেয়া থেকে বঞ্চি হবে। সূত্র জানায়, আগামী বছরের ২ মার্চের পর থেকে ভোটার তালিকা হালনাগাদে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করবে ইসি। এই তথ্য অনুযায়ী তারা ২০২৬ সালের ২ মার্চের চূড়ান্ত হালনাগাদ ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে। এ ক্ষেত্রে ২০২৫ শেষে অথবা ২০২৬ শুরুতে সংসদ ভোট করতে গেলে নতুন ভোটরা বাদ পড়ে যাবে। বিদ্যমান ভোটার তালিকা দিয়ে ভোটগ্রহণ করতে হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইসি ভোটার তালিকা হালনাগাদ না করে দ্রুত ভোট দিলে অনেক নাগরিক ভোট দেয়া থেকে বঞ্চিত হবে। বর্তমান ভোটার তালিকা নিয়ে রাজনৈতিক অনেক দল প্রশ্ন উঠাতে পারে।
জানা যায়, জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের আগামী নির্বাচন নিয়ে ধারণা দেয়ার পরদিন তার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। তবে কম সংস্কার হলে তা ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে হতে পারে। গত মঙ্গলবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা বলেন। বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চেয়েছে- এমন এক প্রশ্নে শফিকুল আলম বলেন, নির্বাচনি রোডম্যাপ খুব স্পষ্ট দেয়া হয়েছে। যদি কম সংস্কার হয় তাহলে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে হতে পারে। উনি (প্রধান উপদেষ্টা) একটা আলোকপাত করেছেন। চূড়ান্ত তারিখ কী? সেটা নির্ভর করবে সংস্কারের ওপর। তিনি একটা সময় দিয়ে দিয়েছেন। এর চেয়ে পরিষ্কার রোডম্যাপ কী হতে পারে? আপনি আশা করতে পারেন নির্বাচন হচ্ছে ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে। আগের দিন গত সোমবার বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে ভাষণে আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি নিয়ে ধারণা দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ভোট কবে হবে তা নির্ভর করবে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে কতটা সংস্কার করে নির্বাচনে যাওয়া হবে, তার ওপর। মোটাদাগে এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে হতে পারে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন।
ছাত্র জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেয়ার চার মাসের মধ্যে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের বিষয়টি বারবার আলোচনায় এসেছে। এ সময়ে সরকারের বিভিন্ন উপদেষ্টা, এমনকি সেনাপ্রধানও নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন। তবে সেগুলো ছিল তাদের ব্যক্তিগত অভিমত, অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত নয়। এর মধ্যে বিএনপির তরফ থেকে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি তোলা হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পূর্তিতে গত ১৭ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে এসে মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে, সেই ট্রেন আর থামবে না। তবে সেদিন এর আগে রাষ্ট্র সংস্কারে সরকারের নেয়া উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন তিনি। এর এক মাসের মাথায় বিজয় দিবসের সকালে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে এসে প্রথমবারের মতো নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি নিয়ে কথা বললেন ইউনূস।
পরদিন নিয়মিত ব্রিফিংয়ে নির্বাচন বিষয়ক প্রশ্নে প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, এটা তো স্পষ্ট রোডম্যাপ। এখন আপনি যদি বলেন মনোনয়ন দাখিলের সময় কবে? এ সময় এ বিষয়ে উপপ্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেন, নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ, কবে মনোনয়ন দাখিল হবে এগুলো নির্বাচন কমিশনের কাজ। সরকারের কাজ হচ্ছে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করা, নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু হয়। এজন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারের জাতীয় দাবি আছে রাজনৈতিক দল ও মানুষের পক্ষ থেকে। জুলাই বিপ্লবের চেতনাও হচ্ছে এটা। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুরোপুরি ধ্বংস করা হয়েছে। মানুষ দীর্ঘদিন ধরে ভোট দিতে পারে নাই। প্রধান উপদেষ্টার কাছে তরুণদের দাবি তারা যেন ভোট দিতে পারে, নাগরিক অধিকার নিশ্চিত যেন হয়।
সংস্কার কমিশনগুলো দ্রুত প্রতিবেদন দেবে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের ভিত্তিতে জাতীয় উদ্যোগের চেষ্টা হবে। সেই লক্ষ্যে একটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করারও প্রস্তাব প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে দিয়েছেন। জাতীয় ঐকমত্যে সংস্কারের বিষয়গুলো তৈরি হয়ে গেলে নির্বাচনের দিনক্ষণ নির্বাচন কমিশন জানিয়ে দিতে পারবে।
নির্বাচনের প্রস্তুতির কাজ কমিশন শুরু করে দিয়েছে বলে তুলে ধরে উপপ্রেস সচিব বলেন, নির্বাচনের চূড়ান্ত দিনক্ষণ জানতে হলে সবার উচিত নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করা। মোটাদাগে সরকার নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমার কথা বলেছেন। এ সময়ে মধ্যে থেকে নির্বাচন আয়োজন করতে গেলে যে যে প্রয়োজনীয়তার কথা ইতিমধ্যে আলোচিত হয়েছে বা এখনো আলোচনা হচ্ছে বা সামনে যে ইস্যুগুলো আসবে সেগুলো নিয়ে সরকার কীভাবে কাজ করবে তার রূপরেখা, পদ্ধতির আউটলাইন প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে ঘোষণা করেছেন। এদিকে নির্বাচন কমিশন সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) একেএম নাসির উদ্দিন। গত মঙ্গলবার আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে নিজ কার্যালয় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, জাতীয় নির্বাচনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত রয়েছে কমিশন। প্রধান উপদেষ্টা বা অন্তর্বর্তী সরকার যখন চাইবেন তখনই নির্বাচন করতে প্রস্তুত ইসি।
সিইসি নাসির উদ্দিন আরও বলেন, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের যে ইন্ডিকেশন দিয়েছেন সেটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তিনি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়ে কোনো কিছু বলেননি। আমাদের যারা স্টেক হোল্ডার রাজনৈতিক দল- তারাও সংসদ নির্বাচনের কথা বলেছেন। তারা অন্তবর্তীকালীন সরকারের থেকে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তাস্তরের কথা বলেছেন। কাজেই আমরা সংসদ নির্বাচনের কথা ভাবছি। এর অগে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, আগামী বছরের ২ মার্চের পর থেকে ভোটার তালিকা হালনাগাদে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করবে ইসি। এই তথ্য অনুযায়ী তারা ২০২৬ সালের ২ মার্চের চূড়ান্ত হালনাগাদ ভোটার তালিকায় ভোটার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবেন। তবে এর আগে আইন অনুযায়ী, আগামী বছরের ২ মার্চ চলতি বছরের হালনাগাদ চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে।
আইন অনুযায়ী, প্রতিবছর ২ জানুয়ারি আগের বছরের হালনাগাদ ভোটার তালিকার খসড়া প্রকাশ করা হয়। ২ মার্চ প্রকাশ করা হয় চূড়ান্ত তালিকা। তবে এ বছর বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়নি। নির্বাচন কমিশনের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি ভোটার হওয়ার উপযুক্ত কোনো ব্যক্তি নিজ উদ্যোগে ইসি কার্যালয়ে গিয়েও ভোটার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন। আবার নির্বাচন কমিশন বাড়ি বাড়ি গিয়ে হালনাগাদের সময় আগাম তথ্যও সংগ্রহ করে রাখে। বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার পর তাদের নাম ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, নতুন ভোটার হিসেবে যুক্ত হওয়ার জন্য ইসির কাছে ১৭ লাখ নাগরিকের তথ্য সংগ্রহে রয়েছে। এসব নাগরিক ২০২৫ সালে যে তালিকা প্রকাশ করা হবে, সেখানে তারা যুক্ত হবেন। এই ১৭ লাখ নাগরিকের মধ্যে ১৩ লাখের তথ্য নির্বাচন কমিশন ২০২২ সালে সংগ্রহ করেছিল। বাকি নাগরিকরা নিজেরা ইসির কার্যালয়ে গিয়ে নিবন্ধিত হয়েছেন। তবে তাদের ধারণা, পরিসংখ্যান অনুযায়ী চলতি বছর ৪৫ লাখের মতো নাগরিকের নতুন ভোটার হিসেবে যুক্ত হওয়ার কথা। সে হিসাবে ২৭ থেকে ২৮ লাখ ভোটার হওয়ার যোগ্য নাগরিক এ বছর এখনো ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত হননি।
আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, এই বাস্তবতায় কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আগামী ২ জানুয়ারি খসড়া প্রকাশের পর শুনানি, দাবি-আপত্তির পর ২ মার্চ চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে। ইসি চায়, যারা বাদ পড়েছেন, তারা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হোক। এ জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই বাদ পড়া ভোটাররা ছাড়াও ২০২৫ সালে যারা ভোটার হবেন, অর্থাৎ ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত যারা ভোটার হবেন, তাদের তথ্যও বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংগ্রহ করা হবে। তিনি জানান, একই সঙ্গে যেসব ভোটার মারা গেছেন, তাদের নাম ভোটার তালিকা থেকে কর্তন করার জন্য তথ্য নেওয়া হবে।
এ ছাড়া দ্বৈত ভোটার বা অন্য কোনো জটিলতা আছে কি না, সে বিষয়েও তথ্য সংগ্রহ করা হবে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহসহ যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করতে ছয় মাসের মতো সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কবে থেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হবে, তা এখনো ঠিক হয়নি। এ বিষয়ে ইসি সচিবালয় থেকে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হবে। তবে তারা ধারণা করছেন, আগামী ২ মার্চের পর এই কাজ শুরু করতে পারবেন।
আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, কমিশন নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যখনই কোনো একটি নির্বাচন সামনে আসবে, চেষ্টা থাকবে তফসিল ঘোষণার আগে একটা সময় পর্যন্ত যেন ভোটার হওয়ার যোগ্যদের তালিকাভুক্ত করা যায়।