ফের আন্দোলনের প্রস্তুতি বিএনপির
প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আমিরুল ইসলাম অমর
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা সরকারের পতন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে দীর্ঘদিন আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে আসা বিএনপি এবার নতুন করে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। এরপর থেকেই বিএনপি দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। যদিও সরকার বলছে, আগে সংস্কার পরে নির্বাচন। গত ১৬ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টা ভাষণে জানিয়েছিলেন, অল্প সংস্কার হলে ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়তো সম্ভব হবে। প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কারে আরো ছয় মাস অতিরিক্ত লাগতে পারে। ২০২৫ সালের শেষ থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধে নির্বাচন হতে পারে বলে আভাস দিয়েছিলেন তিনি। পরের দিন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জানান, ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে। অন্যরা স্বাগত জানালেও এ বক্তব্য যৌক্তিক নয় বলে বিএনপি প্রকাশ্যেই জানিয়েছে।
বিএনপি এবার নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপের দাবিতে আন্দোলনে নামার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। আগামী বছরের জানুয়ারির মধ্যেই নির্বাচনের বিষয়ে সুষ্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা না হলে ফেব্রুয়ারির প্রথম থেকেই কর্মসূচি শুরুর ইঙ্গিত দিয়েছেন নেতারা। এর সঙ্গে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ অন্যান্য দাবিও থাকবে। গত বুধবার জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। এমন প্রেক্ষাপটে নির্বাচন ও আন্দোলন ইস্যুতে নতুন কর্মকৌশল ঠিক করছে বিএনপি। এরই অংশ হিসাবে চলমান পরিস্থিতি, নির্বাচন ও মাঠের কর্মসূচির বিষয়ে মিত্র রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ফের বৈঠকে বসছে দলটি। গতকাল শনিবার থেকে এই বৈঠক শুরু হয়েছে। সমমনাসহ ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়া অন্তত ৫০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। সংস্কার ও জাতীয় নির্বাচনের সময় নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা-সমালোচনার এই মুহূর্তে মিত্রদের সঙ্গে বৈঠক তাৎপর্যপূর্ণ বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিএনপি মনে করে, পতিত ফ্যাসিবাদীদের দেশবিরোধী নানামুখী ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত মোকাবিলায় নির্বাচনই এখন সরকারের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত এবং সেদিকেই তাদের ফোকাস করতে হবে। এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠিত হয়েছে। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে এখনো সুনির্দিষ্টভাবে দিনক্ষণ না বলায় নির্বাচনের উদ্যোগ নিতে পারছে না ইসি। তাই নির্বাচনের প্রস্তুতি এবং সরকারের ওপর রোডম্যাপের চাপ অব্যাহত রাখার অংশ হিসেবে বড় বড় সভা-সমাবেশ করার চিন্তাভাবনা করছে বিএনপি। গত বুধবার অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বেশ কয়েকজন নেতা এমন প্রস্তাব দেন। কারণ সরকারের অবস্থান স্পষ্ট না হওয়ায় ইসি গঠনের পরও নির্বাচন নিয়ে তারা এখনো পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারছেন না।
বিএনপি এখন রাষ্ট্র মেরামতের দলীয় রূপরেখা ৩১ দফাকে নতুন করে ব্র্যান্ডিংয়ে ব্যস্ত। এ নিয়ে বিভাগীয় প্রশিক্ষণ কর্মশালার পর এখন জেলাভিত্তিক কর্মশালা চলছে, যেখানে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হচ্ছেন। জেলা পর্যায়ে এ কার্যক্রম শেষ হলে তখন নির্বাচনের দাবিতে আরো সোচ্চার হবে দলটি। এর অংশ হিসেবে সারা দেশে সভা-সমাবেশ করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
দ্রুত নির্বাচন চাইলেও কতদিনের মধ্যে ভোট চায়, তা বলছে না বিএনপি। সূত্র জানায়, দলের স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হয়েছে ছয় মাসের মধ্যেই নির্বাচন সম্ভব। বিএনপি কেন নির্বাচনের জন্য তাড়া দিচ্ছে, এর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। গত বুধবার তিনি বলেছেন, ‘অনেকে বলেন, আমরা শুধু ভোটের কথা বলি। আমরা রাজনীতি করি। আমরা ভোটের কথা বলব, এটাই স্বাভাবিক।’
গত বুধবার রাতে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী স্থায়ী কমিটিতে ড. ইউনূসের ভাষণ এবং প্রেস সচিবের বক্তব্য নিয়ে আলোচনা হয়। বিএনপির স্থায়ী কমিটি লিখিত বক্তব্যে জানায়, ড. ইউনূসের ভাষণে নির্বাচনবিষয়ক বক্তব্য অস্পষ্ট। তার বক্তব্যে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় বলা হলেও পথনকশা নেই।
স্থায়ী কমিটির সভা থেকে বলা হয়েছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২০২৫ সালের শেষ অথবা ২০২৬ সালের প্রথম অংশে নির্বাচনের কথা বলেছেন, যা অস্পষ্ট। তার প্রেস সচিব বলেন, ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে, যা পরস্পরবিরোধী। স্থায়ী কমিটি মনে করে, এ ধরনের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘তাদের দেওয়া বক্তব্য কোনটা সঠিক, আমরা বুঝতে পারছি না।’ বিএনপি মহাসচিব বলেন, স্থায়ী কমিটি মনে করে, নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কারগুলো সম্পন্ন করে দ্রুত ভোট সম্ভব। নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় রাজনৈতিক দল ও অন্য অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করা উচিত। বিএনপি নেতারা বলছেন, নির্বাচন নিয়ে তারা কোনো তাড়াহুড়া করছেন না; বরং সরকারকে তারা সহায়তা করতে চান এবং করছেনও। এজন্য সরকারকে তারা যৌক্তিক সময় দিচ্ছেন। গত ১৫-১৬ বছর ধরে ভোটাধিকারবঞ্চিত জনগণ এখন যেহেতু ভোট দেয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে রয়েছে, তা ছাড়া এতদিন নির্বাচনের ওপর রাজনৈতিক দলগুলোরও আস্থা ছিল না; তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন সরকারের উচিত, রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। তাহলে দলগুলো একদিকে যেমন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে পারবে, অন্যদিকে সরকারের সংস্কার কার্যক্রমেও সহায়তা করতে পারবে। কারণ মেয়াদের প্রায় সাড়ে চার মাস অতিবাহিত হলেও সরকার সুনির্দিষ্টভাবে কী করতে চায়, সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। নির্বাচনের ব্যাপারে তারা এখনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারেনি, এটিই দলটির হতাশার জায়গা। কারণ বিএনপি এই সরকারকে ব্যর্থ দেখতে চায় না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপের ধারা বাতিল করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর বিষয়ে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছে, বিএনপি সেটিকে স্বাগত জানিয়েছে। বিএনপি মনে করে, ওই রায়ে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরলেও সেই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার ফরম্যাট কী হবে, সেটি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন আছে। নেতারা বলছেন, দেশে পাঁচ বছর পর পর নির্বাচন নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়, সেটা যাতে না হয়, সেজন্য রাজনৈতিক মতৈক্য প্রয়োজন, যাতে এই ব্যবস্থাকে আরো গ্রহণযোগ্য ও শক্তিশালী করা যায়।
রাজনৈতিক সূত্র বলছে, অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পালানো এবং ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ভেঙে পড়ায় আগামী নির্বাচনে বিএনপির বিজয় একরকম নিশ্চিত। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত চারটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ভোটের পরিসংখ্যানও বিএনপির পক্ষে। সারা দেশে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সাংগঠনিক কাঠামো থাকায়, আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে আগামী নির্বাচনে বিএনপির একচেটিয়া জয় সম্ভব। এ কারণেই দলটি দ্রুত নির্বাচনের চাপ দিচ্ছে।
এদিকে বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা জানান, জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার দেয়া বক্তব্য ‘অস্পষ্ট’। তারা স্পষ্ট নির্বাচনি রোডম্যাপ চান। সেক্ষেত্রে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করা উচিত। নেতারা মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ ও অকার্যকর করে তুলতে বহু আয়োজন চলছে, যার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তি ও নানা অশুভ চক্র। এসব বিবেচনায় রেখেই সরকারকে প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নির্ধারণ করতে হবে। সরকারের কাজের গতি ও দক্ষতা থাকলে ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে দ্রুত সময়ের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব। তারা আশা করেন, প্রধান উপদেষ্টা, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়া রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করবেন। যেন কোনো ধরনের ভুল বোঝাবুঝি না হয়।
জানা গেছে, গত বুধবার বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভা হয়। ওই সভায় নেতারা বলেন, নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিলম্বের প্রয়োজন নেই। এ সংক্রান্ত সংস্কারগুলো সম্পন্ন করে দ্রুত ভোটের আয়োজন করা সম্ভব। জনগণ এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রত্যাশা করে। স্থায়ী কমিটির সভায় নেতারা মনে করেন, নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করা উচিত। এছাড়াও সভায় ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। লিয়াজোঁ কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্যদের এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আজ থেকে চলমান পরিস্থিতিতে ভবিষ্যৎ করণীয় নিয়ে মিত্রদের সঙ্গে বৈঠক শুরু করছে বিএনপি।
বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলের একাধিক শীর্ষ নেতা জানান, গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। এমনকি দীর্ঘ বছর ধরে স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ভোট দিতে পারেনি। তাই জনগণ ভোট দেয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। এখন পট পরিবর্তনের পর জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কালক্ষেপণ হলে জনগণও তা ভালোভাবে নেবে না। আবার কালক্ষেপণের পেছনে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের কথা শোনা যাচ্ছে। যে কারো রাজনৈতিক দল গঠনের অধিকার আছে, এ ধরনের উদ্যোগকে তারা স্বাগত জানায়। তবে সরকারের ‘অনুকম্পা’ নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দল যেন না হয়। অতীত ইতিহাস বলে এই ধরনের উদ্যোগ জনগণ গ্রহণ করে না।