অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন করা ১১টি সংস্কার কমিশনের মধ্যে প্রথম ধাপের ছয়টি কমিশন তাদের প্রস্তাব ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারের কাছে জমা দেবে। আর দ্বিতীয় ধাপের পাঁচটি সংস্কার কমিশন ফেব্রুয়ারিতে প্রস্তাব জমা দেবে।
জানা গেছে, বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞ বিশিষ্ট নাগরিকদের নিয়ে নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, জনপ্রশাসন এবং সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। প্রথম ধাপের সংস্কার কমিশন প্রস্তাবের পর দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংস্কারের ধারণা নিয়ে আলোচনা করবেন। পরে সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতেই সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হবে। দ্বিতীয় ধাপে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন, স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন, শ্রমিক অধিকারবিষয়ক সংস্কার কমিশন এবং নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। এই পাঁচ কমিশন প্রস্তাব জমা দেবে ফেব্রুয়ারিতে। তবে, এরইমধ্যে সংস্কার কমিশনের প্রধানরা সম্ভাব্য প্রস্তাবগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন।
গত ১৬ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, যে কোনো সংস্কারের কাজে হাত দিতে গেলে রাজনৈতিক ঐকমত্যের প্রয়োজন হয়। অন্তর্বর্তী সরকার প্রথম পর্যায়ে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এসব কমিশন শিগগিরই প্রতিবেদন পেশ করবে বলে তিনি আশা করছেন। এই ছয় কমিশনের চেয়ারম্যানদের নিয়ে ‘জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন’ করার দিকে অন্তর্বর্তী সরকার অগ্রসর হচ্ছে বলে জানান তিনি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সংস্কার কমিশন পর্যালোচনার পাশাপাশি অংশীজনদের মতামত নিচ্ছে। এরই মধ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন অনলাইনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মতামত নেয়ার পাশাপাশি অংশীজনদের সঙ্গে সরাসরি মতবিনিময় করছে। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকেও লিখিত মতামত নেয়া হয়েছে। সংবিধান সংস্কার বিষয়ে বিবিএসের মাধ্যমে সারা দেশে একটি জরিপ চালিয়েছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। এই কমিশন সংবিধান বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে মতবিনিময়ের পাশাপাশি প্রধান বিচারপতির সঙ্গেও সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছে।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার : বিগত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছিল তা বন্ধে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন পরিবর্তন, স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বাদ, প্রবাসীদের ভোট দেয়ার বিধান চালু, ইভিএম বাতিলসহ বেশ কিছু আইনে পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন সংস্কার কমিশন।
কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, যেসব বিষয় সংস্কারের কাজ শুরু করেছি সেটি বাস্তবায়ন হলে আগামীতে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। নির্বাচনে স্বচ্ছ ভোটার তালিকা প্রস্তুত, রাজনৈতিক দলের মধ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, নির্বাচনি অপরাধ বন্ধে আইনে সংস্কারের মতো বিষয়গুলোতেও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, জনপ্রশাসন জনগণের প্রশাসন হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তা হয়ে ওঠেনি। জনপ্রশাসন এখনও ব্রিটিশ নিয়মেই চলছে। যেমন গার্ড অব অনার দেওয়া, কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গেলে তার জন্য আচার অনুষ্ঠান আয়োজন করা। কিন্তু জনপ্রশাসনের উচিত জনগণের স্বার্থে কাজ করা। তবে ৫৩ বছরেও সেটি বাস্তবায়ন হয়নি।
সংবিধান সংস্কার : সংবিধান সংস্কার বিষয়ক কমিশন কাজ শুরুর পর পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল, আনুপাতিক হারে ভোটের বিধান, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ চালু, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানোসহ সংবিধানে বড়সহ বেশকিছু পরিবর্তনের সম্ভাব্য পরামর্শ এসেছে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা পরামর্শগুলো লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। যে যে বিষয়গুলোতে ঐকমত্য আছে, সেগুলোও নোটডাউন করা হয়। আমাদের প্রস্তাবনা সামঞ্জস্য হবে। যাতে পরস্পরবিরোধী না হয়, সেই বিবেচনায় কাজ করা হয়েছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন ৭ অক্টোবর গঠন করা হয়। কমিটি গঠনের পরবর্তী ৯০ দিন হিসাবে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য তাদের সময় থাকছে আগামী বছরের ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত। অধ্যাপক আলী রীয়াজ আরও বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরকারের কাছে খসড়া সুপারিশ জমা দিতে পারবেন বলে আশাবাদী।
পুলিশ সংস্কার : বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশে পুলিশের নানা কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষের কাছে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বিষয়টিকে সামনে রেখে অর্ন্তর্বতী সরকার দেশের পুলিশি কাঠামো ঢেলে সাজানোর কথা বলছে। পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সরফ রাজ হোসেন বলেছেন, বিভিন্ন চাকরির ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনে রাজনৈতিক পরিচয় দেখার কারণে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হয়। যে কারণে আগামীতে সরকারির চাকরির ক্ষেত্রে ভেরিফিকেশনে রাজনৈতিক পরিচয় না দেখার সুপারিশ করা হবে। হাইকোর্টের নির্দেশনা মেনে পুলিশ গ্রেফতার ও রিমান্ডে নিতে পারবে সংস্কার প্রস্তাবে এমন সুপারিশ থাকতে পারে।
এই সংস্কার কমিশন বলছে, বর্তমানে পুলিশ চলছে প্রায় দেড়শ’ বছরের পুরনো আইন দিয়ে। যে কারণ পুলিশি কাঠামো ও এ নিয়ে নানা সংকট থেকে গেছে বছরের পর বছর। যে কারণে পুলিশ সংস্কারে নানা প্রস্তাবনার পাশাপাশি পুলিশ আইন সংস্কারেরও সুপারিশ দেবে কমিশন। ‘কেমন পুলিশ চাই’ শিরোনামে অনলাইনে সাধারণ মানুষের মতামত নিয়েছে পুলিশ সংস্কার কমিশন। পুলিশ সদর দপ্তরের কাছেও সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে। অতীতে বিভিন্ন সময়ে পুলিশ সংস্কার কার্যক্রম এবং অন্যান্য দেশের পুলিশ কীভাবে কাজ করে, সেসবও পর্যালোচনা করা হচ্ছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ও কমিশনার পদে দলীয় প্রভাবমুক্ত যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগের আইন করা; পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কার্যকর সহযোগিতার প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠিত করা যায় সেসব প্রস্তাবনায় থাকতে পারে। এই কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সব মতামত পর্যালোচনা করে একটি জায়গায় পৌঁছেছেন। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে প্রস্তাব পেশ করবেন।
জনপ্রশাসন সংস্কার : সরকারি আমলাদের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি কিংবা পক্ষপাতিত্ব নিয়ে নানা অভিযোগ উঠলেও সেগুলো বন্ধে কঠোর কোনো উদ্যোগও নেয়া হয়নি। গত অক্টোবরে সাবেক আমলা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীকে প্রধান করে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনও গঠন করেছে অর্ন্তর্বতী সরকার। এক্ষেত্রে অনেকে জনপ্রশাসনে দুর্নীতি বন্ধে উদ্যোগ নেয়া, সরকারি চাকরিতে নিয়োগে স্বচ্ছতা, প্রশাসনে বিকেন্দ্রীকরণে উদ্যোগ, বদলি কিংবা পদায়নে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা মানার মতো বিষয়গুলোও উঠে এসেছে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন সম্প্রতি সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, সরকারের উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ এবং অন্যান্য ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ কোটা রাখার সুপারিশ করা হবে। এর পর থেকেই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন প্রশাসন ক্যাডারের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা। তারা সংস্কার কমিশনের এই সুপারিশের প্রস্তাবকে বৈষম্যমূলক, অযৌক্তিক, ষড়যন্ত্রমূলক উল্লেখ করে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীর পদত্যাগ বা অপসারণ দাবি করেছেন প্রশাসন ক্যাডারের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা। এছাড়া কমিশন যদি কোনো ‘অযাচিত’ সুপারিশ করে, তাহলে কঠোর কর্মসূচি দেয়ারও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা। বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি এবিএম আব্দুস সাত্তার বলেন, আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীর অপসারণ চাই। সরকার যদি অপসারণ না করে, কীভাবে অপসারণ করতে হবে, সেই হাতিয়ার আমাদের জানা আছে।