হঠাৎ গত কয়েক সপ্তাহে ঢাকায় ছিনতাইকারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল, গুলিস্থান, মোহাম্মদপুর, ফার্মগেট, মিরপুর, খিলগাঁও, হাতিরঝিল, শাহজাহানপুর, হাজারীবাগ, শাহ আলী, এমনকি গুলশানসহ বিভিন্ন এলাকায় বেড়েছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। সন্ধ্যা নামতেই বেপরোয়া হয়ে উঠছে ছিনতাই চক্রের সদস্যরা। এসব ঘটনায় প্রায়ই গুরুতর আহত হচ্ছে অনেকে। এমনকি প্রাণহানির খবরও পাওয়া যাচ্ছে। ভুক্তভোগী ও নগরবাসী প্রশ্ন তুলছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্রিয়তা নিয়ে। ছিনতাই রোধে পুলিশ নানা পদক্ষেপের কথা জানালেও কার্যত ছিনতাই কমেনি।
পুলিশ ও ঢাকার আদালতসংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার ৫০টি থানা এলাকায় গত ১ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪০ দিনে অন্তত ৩৪ জন ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে মামলা করেছেন। সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন শতাধিক ভুক্তভোগী। এসময় ছিনতাইকারীর হাতে নিহত হয়েছেন একজন। গুরুতর জখম হয়েছেন আরো বেশ কয়েকজন।
পুলিশের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর বিভিন্ন থানায় গত আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৬৫টি। চলতি বছর ঢাকায় জানুয়ারিতে ছিনতাইয়ের মামলা ২৫, ফেব্রুয়ারিতে ২৬, মার্চে ২৮, এপ্রিলে ১৫, মে মাসে ১৯, জুনে ১৬ ও জুলাইয়ে ১৫টি।
পুলিশ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছরের সঙ্গে এ বছরের তুলনা যথার্থ নয়। চলতি বছরের আগস্ট মাসে পুলিশি কার্যক্রম একেবারেই ভেঙে পড়েছিল। এখনো পুলিশি কার্যক্রম পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। সবমিলিয়ে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাড়ে চার মাসে ছিনতাইকারীর হাতে নিহত হয়েছেন সাতজন। পুলিশ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার কারণে এসব ঘটনা বাড়ছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন সরকারের সামনে যেসব বিষয় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আসে তার মধ্যে অন্যতম আইনশৃঙ্খলা রক্ষা। অভ্যুত্থানের পর পুলিশ থানা থেকে পালিয়ে যাওয়ায় অপরাধ দমন কার্যক্রমে স্থবিরতা এসেছিল। নতুন সরকার ঢাকায় পুলিশের জনবলে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। পুলিশের সর্বোচ্চ পদ আইজিপি ও ডিএমপি কমিশনার পদে পরিবর্তন আনা হয়। তারপরও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়নি।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে বেশি আলোচনায় ছিল মোহাম্মদপুর এলাকা। গত ২ নভেম্বর স্থানীয় বাসিন্দারা থানার সামনে বিক্ষোভও করেন। এরপর সেনাবাহিনী, পুলিশ ও র্যাব যৌথ অভিযান শুরু করে।
ছিনতাইয়ের মামলার তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ১ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪০ দিনে ঢাকায় সর্বাধিক তিনটি করে ছিনতাই মামলা হয়েছে মোহাম্মদপুর, খিলগাঁও, হাতিরঝিল ও শাহজাহানপুর থানায়। দুটি করে ছিনতাই মামলা হয়েছে হাজারীবাগ, মিরপুর ও শাহআলী থানায়। একটি করে মামলা হয়েছে ১৬টি থানায়।
৬ বছরে ছিনতাইয়ের ঘটনায় ৪৭ হাজার মামলা : পুলিশের প্রায় ছয় বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৯ থেকে প্রতি বছরই ছিনতাই বেড়েই চলছে। ২০১৯ সাল থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ছিনতাইয়ের ঘটনায় ৪৭ হাজারের বেশি অভিযোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ২০১৯ সালে অভিযোগ ছিল ৬ হাজার ৮৮০টি, ২০২০ সালে ৭ হাজার ২০০, ২০২১ সালে ৮ হাজার ৪৯৮, ২০২২ সালে ৯ হাজার ৫৯১, ২০২৩ সালে ৯ হাজার ৪৭৫ এবং চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ৫ হাজার ৮৮৩টি ঘটনা মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঢাকা মেট্রোপলিটন ও রেঞ্জ এলাকায় ১৫ হাজার ৪১৯টি অভিযোগ রয়েছে। এরপরই রয়েছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ও রেঞ্জে ৭ হাজার ৭৪৬টি। তবে বেশিরভাগ ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা না নেয়ার অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে। ছিনতাইয়ের শিকার অনেকেই ঝামেলা এড়াতে আইনি প্রক্রিয়ায়ও যেতে চান না। সেই হিসাবে ছিনতাইয়ের ঘটনার প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি।
ছিনতাইয়ের কবলে সাংবাদিকরাও : গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ঢাকায় ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন। ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে প্রাণ রক্ষার্থে খুইয়েছেন ক্যামেরা, মোবাইল, টাকা আর ব্যাগ। গত ১৩ নভেম্বর দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার ফটোসাংবাদিক মো. নাঈমুর রহমান রাত ৯টা ৩৫ মিনিটের দিকে মোহাম্মদপুর থানার বসিলা রোডের তিন রাস্তার সামনে পৌঁছালে চারজন সন্ত্রাসী দেশীয় অস্ত্র দিয়ে আঘাতের পর ভয়ভীতি দেখায়। এসময় তার কাছে থাকা নগদ সাত হাজার টাকা, একটি নাইকন ডিএসএলআর ক্যামেরা, একটি নাইকন ক্যামেরার লেন্স, একটি মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে যায়। পরে অবশ্য অভিযান চালিয়ে তিনজন ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
১৬ ডিসেম্বর ছুটির দিন সন্ধ্যার দিকে রাজধানীর মিরপুর সনি সিনেমা হলের সামনে থেকে মফিজুল ইসলাম সাদিক নামে একজন সংবাদকর্মীর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি ছিনতাই হয়ে যায়। তিনি বলেন, মোবাইলটি ছোঁ মেরে নিয়ে যায় ছিনতাইকারী। আশপাশে চিৎকার করলেও আমার কথা কেউ শোনেনি।’ পরে অবশ্য মোবাইল ছিনতাইয়ের ঘটনায় তিনি থানায় জিডি করেন। তবে এখনো তার মোবাইলটি উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।
এদিকে, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক ইনকিলাবের সিনিয়র রিপোর্টার মাইনুল হাসান সোহেলের ওপর দুর্বৃত্তদের হামলা ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে ডিআরইউ। এই ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার করে তাদের আইনের আওতায় আনার দাবি করেছে ডিআরইউ’র কার্যনির্বাহী কমিটি। গতকাল বুধবার ডিআরইউ কার্যনির্বাহী কমিটির পক্ষ থেকে সভাপতি আবু সালেহ আকন মাইনুল হাসান সোহেলের ওপর হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে এই দাবি করেন।
মাইনুল হাসান সোহেল জানিয়েছেন, মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর) রাত ৯টা ২০ মিনিটে কর্মস্থল দৈনিক ইনকিলাবে অফিস শেষে ডিআরইউ যাওয়ার পথে মতিঝিল জনতা ব্যাংকের সামনে চলন্ত রিকশায় তিনজন দুর্বৃত্ত অতর্কিত হামলা চালায় এবং হাতে থাকা মোবাইল (আইফোন) ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এসময় তাদের সাথে ধস্তাধস্তিতে রাস্তায় পড়ে গিয়ে পায়ে ও হাতে গুরুতর আঘাত পান। ঘটনার পর প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে এখন বাসায় অবস্থান করছেন। তিনি জানিয়েছেন এ বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ডিআরইউ সভাপতি বলেন, মাইনুল হাসান সোহেলের ওপর হামলা চালিয়ে মোবাইল ছিনতাই করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। অবিলম্বে জড়িতদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
সূত্রমতে, সায়েদাবাদণ্ডযাত্রাবাড়ী ছিনতাইয়ের অন্যতম হটস্পট হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি হাফেজ কামরুল হাসান রাজধানীর সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডে যাওয়ার জন্য হানিফ ফ্লাইওভার দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। এসময় ছিনতাইকারী তার গতিরোধ করে দেশীয় অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে কাছে থাকা নগদ টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিতে চায়। কামরুল ছিনতাইকারীদের বাধা দেয়ায় ধস্তাধস্তি হয়। একপর্যায়ে ছিনতাইকারীরা হাতে থাকা ধারালো চাকু দিয়ে তার বুকে আঘাত করে।
কামরুল হাসান ফ্লাইওভারের ওপর লুটিয়ে পড়লে ছিনতাইকারীরা তার কাছে থাকা একটি মোবাইল ফোন ও নগদ সাত হাজার টাকা ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় অবশ্য দুই ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতার দুজনের বয়স ১৬ ও ১৭ বছর।
সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, রাজধানীতে ছিনতাই রোধে শেষ রাতে পুলিশি টহল বাড়ানোর জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ঢাকায় ছিনতাই বেড়েছে, এজন্য আমরা পুলিশকে নির্দেশনা দিয়েছি। শেষ রাতে সাধারণত ছিনতাইটা হয়, সেজন্য শেষ রাতে যাতে টহল বাড়িয়ে দেয়া হয়। আপনারা যে কথাটা (ছিনতাই বেড়েছে) বলেছেন, এটার সঙ্গে আমিও দ্বিমত করবো না। এটা যাতে কমিয়ে আনা যায় তবে এটা অ্যালার্মিং কিছু না।
এ বিষয়ে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস বলেছেন, ‘ঢাকায় সম্প্রতি চুরি-ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছে র্যাব। র্যাবের প্রত্যেকটি ব্যাটালিয়নে সংশ্লিষ্ট এলাকার অপরাধপ্রবণ জায়গাগুলো নির্ধারণ করা হচ্ছে। কোন কোন এলাকায় কোন সময়ে চুরি-ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধ বেশি হচ্ছে- সে অনুযায়ী টহল কার্যক্রমসহ চেকপোস্ট বাড়ানো হচ্ছে। বিশেষ করে মধ্যরাত এবং ভোরে বাসসহ বিভিন্ন টার্মিনালে যখন যাত্রীরা নামেন, তখন ওইসব এলাকায় চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা বেশি ঘটছে।’ তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে র্যাব বেশ কয়েকজন ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করেছে। বাকিদের গ্রেফতারেও অভিযান চলমান। চুরি-ছিনতাই এবং সব ধরনের অপরাধ নির্মূলে র্যাব সদা প্রস্তুত।’
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এস এন মো. নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘ঢাকার ছিনতাইপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে কারা ছিনতাই করে তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। ডিএমপির প্রত্যেক বিভাগের ডিসি, এডিসি ও এসিকে নজরদারি করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। প্রত্যেক রাতে তারা গাড়ি নিয়ে মুভে থাকছে এবং তদারকি করছে। এছাড়া ডিএমপি কন্ট্রোলরুম থেকে ওয়ারলেসে পেট্রলগুলোর লোকেশন নেয়া হচ্ছে এবং তারা সজাগ আছে কি না সেটিও তদারকি করা হচ্ছে।’
ছিনতাইকারীদের জামিনে বের হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যারা এসব ছিনতাইয়ের কাজে অভ্যস্ত তাদের আদালতে পাঠালে তারা অতি সহজেই জামিনে বের হয়ে আসছে এবং আবার ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ছে। ঢাকা মহানগরীতে দুই কোটির মতো মানুষের বসবাস। এসব ছিনতাইকারী যেন সহজে জামিন না পায় এজন্য আদালত বা সংশ্লিষ্টদের কাছে অনুরোধ থাকবে।’
ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেছেন, ‘আমি দায়িত্ব নেয়ার পর চেষ্টা করছি ঢাকা শহরে চুরি-ছিনতাই ও ডাকাতির মতো ঘটনা যেন না হয়। এরই মধ্যে ডিএমপির সবগুলো বিভাগ ও গোয়েন্দা বিভাগকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, তারা ছিনতাইকারীদের ধরতে অভিযান চালাচ্ছে। গত কয়েকদিনে দুই শতাধিক ছিনতাইকারীকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘ইদানীং মোবাইল ছিনতাই বেড়েছে। মোবাইল ছিনতাই প্রতিরোধেও পুলিশ মোড়ে মোড়ে কাজ করছে। এছাড়া জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন পেলে মুহূর্তেই ছুটে যাচ্ছে পুলিশ। তবে সবকিছু মিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি।’