ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, শিক্ষা সংস্কারক ও সমাজহিতৈষী খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা। তিনি একজন উচ্চ স্তরের আউলিয়া ছিলেন। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) বাঙালি মুসলমানদের অহংকার এবং তার কালের আলোকিত এক সূর্যস্নাত মহাপুরুষ। তিনি দীর্ঘ আয়ুষ্কাল পেয়েছিলেন। তার বিস্তৃত কর্মময় জীবন এখন ইতিহাসের অন্তর্গত। এই ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ তার জীবনের প্রায় পুরোটা সময় অনগ্রসর মুসলমান জাতির উন্নয়নের জন্য ব্যয় করেছেন। সেবাই ছিল তার জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। এই দেশ এবং জাতি খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লার (র.) এর কাছে নানাভাবে ঋণী। যার অগ্রগামিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা তার সমগ্র জীবনকালে যেমন নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন, তেমনি কলকাতার বিখ্যাত বেকার হোস্টেলসহ কলকাতা ও কলকাতার বাইরে অনেক ছাত্র-হোস্টেল স্থাপনেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন। ১৯১৯ সালের নভেম্বর মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটে উত্থাপিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিল পর্যালোচনার জন্য গঠিত স্পেশাল কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন আহ্ছানউল্লা। ১৮৭৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর প্রত্যুষে সুফী সাধক খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জের নলতা মোবারকনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আজ তার ১৫১তম জন্মবার্ষিকী। তার জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে লায়ন্স ক্লাব অব ঢাকা ওয়েসিস’র সহযোগিতায় ও ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন স্বাস্থ্য সেক্টরের উদ্যোগে ঢাকার সাভারের বিরুলিয়ায় আগামীকাল ২৮ ডিসেম্বর মায়ের হাসি জেনারেল হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে দিনব্যাপী ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়েছে। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লার পিতা মুন্সী মোহাম্মদ মুফিজ উদ্দীন একজন ধার্মিক, ঐশ্বর্যবান ও দানশীল ব্যক্তি ছিলেন। তার মায়ের নাম মোছা. আমিনা বেগম। তার সমগ্র জীবন ছিল দৃষ্টান্তমূলক। পাঁচ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার পূর্বে পাঠশালার গন্ডিতে প্রবেশের মাধ্যমে শিক্ষাজীবনে পদার্পণ করে নলতা মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়, টাকী গভর্নমেন্ট হাইস্কুল, কলকাতার এলএমএস ইনস্টিটিউশনে পড়াশুনা করে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে কৃতিত্বের সাথে বর্তমান এসএসসি সমমানের তৎকালীন এনট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে তিনি হুগলী কলেজ থেকে ১৮৯২ সালে বর্তমানে এইচএসসি সমমানের তৎকালীন এফএ এবং কলিকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৮৯৪ সালে বিএ পাস করেন। এরপর ১৮৯৫ সালে তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে এম.এ পাস করেন। কর্মজীবনে ১৮৯৬ সালে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে সুপারনিউমারি টিচার হিসেবে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেন। অল্প কিছুকালের মধ্যেই তিনি উচ্চতর বেতনে ফরিদপুরের অতিরিক্ত ডেপুটি ইন্সপেক্টর হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। ১৮৯৮ সালের ১ এপ্রিল খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) বাকেরগঞ্জের ডেপুটি ইন্সপেক্টর পদে নিয়োগ পান। পরবর্তীতে তিনিই সর্বপ্রথম ইন্সপেক্টিং লাইন থেকে টিচিং লাইনের প্রভিন্সিয়াল সার্ভিসে অন্তর্ভুক্ত হয়ে ১৯০৪ সালে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের হেড মাস্টার পদে নিযুক্ত হন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় তার কর্মদক্ষতার স্বীকৃতি হিসেবে ১৯০৭ সালে চট্টগ্রাম বিভাগের ডিভিশনাল ইন্সপেক্টর পদে উন্নীত হয়ে দীর্ঘ ১৭ বছর যাবৎ চট্টগ্রাম অঞ্চলে শিক্ষার প্রভূত উন্নতি সাধন করেন। চট্টগ্রাম বিভাগে কর্মরত থাকাকালীন তিনি ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিসে (আই.ই.এস) অন্তর্ভুক্ত হন। এরপর ‘বঙ্গদেশের মোছলেম শিক্ষার সহকারি ডিরেক্টর’ হিসেবে খানবাহাদুর আহছানউল্লা (র.) পদোন্নতি লাভ করেন এবং ৫ বছর এ পদে সুষ্ঠভাবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে কলকাতায় স্থানান্তরিত হওয়ার পর নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে তিনি কিছুদিন অবিভক্ত বাংলা ও আসামের শিক্ষা বিভাগের ডিরেক্টর পদে দায়িত্ব পালন শেষে ১৯২৯ সালে ৫৫ বছর বয়সে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা-এর শিক্ষা বিভাগের সহকারী পরিচালক হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্তি বাংলার মুসলিম ইতিহাসে এক নতুন মাইলফলক। এই দায়িত্ব প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে মুসলিম শিক্ষার উন্নতি ও প্রসারের গুরু দায়িত্ব তার উপর অর্পিত হয়। তিনিও তার মেধা, বুদ্ধিমত্তা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। মুসলিম শিক্ষার প্রতিবন্ধকতা ও অনাগ্রহ দূরীকরণে এবং অগ্রগতি সাধনের অনুকূলে উচ্চ পর্যায়ে নীতি নির্ধারণে তার ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। নতুন দায়িত্বে যোগদানের পরপরই তিনি দীর্ঘদিন ধরে স্থগিত স্ক্রীমসমূহ বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কলকাতার মুসলিম ছাত্রদের জন্য একটি স্বতন্ত্র কলেজ প্রতিষ্ঠার দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা দায়িত্ব গ্রহণের এক মাসের মধ্যেই মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামিয়া কলেজ। ইসলামিয়া কলেজ ছাড়াও তিনি বহু স্কুল, কলেজ ও হোস্টেল প্রতিষ্ঠা এবং উন্নয়নের সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তারই উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম মুসলিম হাইস্কুল। ১৯২৮ সালে মোছলেম এ্যাংলো ওরিয়েন্টাল গার্লস কলেজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তার অবদান প্রশংসনীয়। এছাড়াও তার প্রতিষ্ঠিত স্কুলগুলোর মধ্যে রয়েছে মুসলিম হাইস্কুল, চট্টগ্রাম (১৯০৯), মাধবপুর শেখ হাই স্কুল, কুমিল্লা (১৯১১), রায়পুর কে.সি হাই স্কুল (১৯১২), চান্দিনা পাইলট হাইস্কুল, কুমিল্লা (১৯১৬), কুটি অটল বিহারী হাইস্কুল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া (১৯২০), চন্দনা কেবি হাইস্কুল, কুমিল্লা (১৯২০), চৌদ্দগ্রাম এইচজে পাইলট হাইস্কুল (১৯২১) উল্লেখযোগ্য। দীর্ঘ কর্মজীবনে শিক্ষা সংস্কারে অবদান রেখে অবসর গ্রহণের পর স্বদেশবাসীর ‘রূহানী খেদমত’ এবং সমাজসেবার ব্রত নিয়ে খানবাহাদুর আহছানউল্লা ১৯৩৫ সালের ১৫ মার্চ ‘আহ্ছানিয়া মিশন’ নামে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন, যার প্রধান কার্যালয় তার জন্মভূমি সাতক্ষীরার কালীগঞ্জের নলতা শরীফে অবস্থিত। ‘আহ্ছানিয়া মিশন’ মূলত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) এর বিশ্বাস, আদর্শ এবং অন্তর্গত সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ। তিনি মিশনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য স্থির করেন- ‘স্রষ্টার ইবাদত ও সৃষ্টের সেবা’। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, আত্মজীবনী, ধর্ম ও সৃষ্টিতত্ত্ব, রাসুলের (স.) জীবনী এবং পাঠ্যপুস্তকসহ ৭৯টি গ্রন্থ রচনা করেন। তার রচিত আমার জীবনধারা (১৯৪৬) বাংলা ভাষায় আত্মজৈবনিক রচনাসমূহের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। তার ভাষা প্রাঞ্জল ও হৃদয়গ্রাহী। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা তার কর্মক্ষেত্রে দক্ষতার স্বীকৃতি অল্প সময়ের মধ্যেই অর্জন করেন। ১৯১১ সালে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক তাকে ‘খানবাহাদুর’ উপাধি প্রদান করা হয়। তিনি চাকরিতে প্রবেশের মাত্র ১৫ বৎসরের মধ্যে এই সাফল্য অর্জন করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এক দশকেরও বেশি সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোটের (বর্তমান সিনেট) মেম্বার ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি লগ্নে ড. নাথান সাহেবের অধীনে টিচিং কমিটির মেম্বার ছিলেন। বাংলা সাহিত্যে বিশিষ্ট ও বহুমুখী অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমি তাকে ১৯৬০ সালে সম্মানসূচক ‘ফেলোশিপ’ প্রদান করেন। সমাজ সেবা ও সমাজ সংস্কৃতিতে বিশেষ করে দীন প্রচারের কাজে অবদানের জন্য ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ তাকে ১৪০৪ হিজরীতে মরণোত্তর পুরষ্কারে ভূষিত করে। বাংলার মুসলমানদের আধ্যাত্মিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে তিনি তার জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছেন।
১৯৬৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার সকাল ১০টা ১০ মিনিটে ৯২ বছর বয়সে সাতক্ষীরা জেলার নলতায় খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) প্রয়াত হন। প্রায় একটি শতাব্দীকালের সূর্যস্নাত মহাপুরুষ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বার বার স্মরিত ও উচ্চারিত হবেন। সবশেষে বলতে চাই, খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) মানবতার কল্যাণে কাজ করেছেন ও দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। সমগ্র জীবনে মানবের মঙ্গল চেয়েছিলেন খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে শতাধিক বই লিখেছেন, বর্তমান সময়ে তার বই বেশি বেশি পড়তে হবে, বুঝতে হবে ও তার পথকে অনুসরণ করতে হবে।