ঢাকা ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৪ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ফিরে দেখা ২০২৪

বিতর্ক থেকে ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার পথ তৈরি

বিতর্ক থেকে ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার পথ তৈরি

২০২৪ সালের নির্বাচন কমিশন (ইসি) নিয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে। দেশের ইতিহাসে এই বছরটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বছরের শুরুতে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে টানা চতুর্থবারের ক্ষমতায়নের মধ্য দিয়ে ভয়াবহ পতনও নিশ্চিত হয় বাংলাদেশের প্রাচীন দল আওয়ামী লীগের। ঠিকমতো মাস সাতেকও টিকতে পারেনি শেখ হাসিনার সরকার। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকল তার জঘণ্য ক্ষমতাচ্যুতি ও গণআন্দোলনের ফসল অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতায়ন। ২০২৪ হাসিনার পতনের মধ্যে দিয়ে জনগণের ভোটের অধিকার ফিরে পাওয়ার পথ তৈরি হয়েছে। জানা যায়, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের তোড়ে ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছেড়ে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলে আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছর ৭ মাসের শাসনের অবসান ঘটে। এর পরপরই ঢাকায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু জাদুঘর, ঢাকায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ কয়েকটি কার্যালয়ে ব্যাপক হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। দেশের বহু জায়গায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়িঘর, দোকানপাটেও হামলার ঘটনা ঘটেছে। একমাত্র গোপালগঞ্জে শুধু আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা ‘শেখ হাসিনাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে’ দাবি করে গত ৫ আগস্টের পর পর বেশ কয়েক দফায়, কয়েকদিন ধরে বিক্ষোভ মিছিল করেছে। শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পরপরই দলের নেতারা আত্মগোপনে। দলটির কোনো স্তরের কোনো নেতাই আর প্রকাশ্যে নেই। বহু মামলা দায়ের হয়েছে শেখ হাসিনাসহ দলের সব নেতার বিরুদ্ধে। পালাতে না পারা অনেকের ঠাঁই হয়েছে কারাগারে। দাপুটে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ বাঘা বাঘা নেতার অনেকে ভারতে আছেন। কেউ কেউ ভারত হয়ে চলে গেছেন নানা দেশে।

এক বছরের মধ্যে দুই কিসিমের দুটি সরকার দেখলো বাংলাদেশ। আগামী বছর আরেকটি দেখার প্রত্যাশা থাকলেও তা ২৬ সালে গড়ানোর নমুনা। নির্বাচন নিয়ে আচ্ছা রকমের রাজনৈতিক জটিলতায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস নিজে অরাজনৈতিক বা রাজনীতির উর্ধ্বে; তার যত কাজ রাজনীতিকদের সঙ্গে। তাদের আয়ত্ত্ব করতে, নিয়ন্ত্রণে নেয়ার চেষ্টায় যে তার অন্ত নেই; কিন্তু কতটা পারছেন তা গোপন থাকছে না। বিতাড়িত আওয়ামী লীগ তার স্পষ্ট প্রতিপক্ষ। বিএনপি-জামায়াতসহ ডান-বামের বাকিরাও একেবারে পক্ষশক্তি নয়। বিপক্ষে না হলেও নির্মোহ সমর্থক নয়। যথাসময়ে, যৌক্তিক সময়ে, যথা শিগগিরই সংস্কার শেষ করে নির্বাচন- এ ধরনের কথায় তারা অসন্তোষ জানাচ্ছিল। জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে- অবিরাম এ জিজ্ঞাসার জবাব আরেকটু খোলাসা করে যেন ড. ইউনূস আরেক ধরনের ফ্যাসাদে পড়ে গেছেন। ২০২৫ সালের শেষ দিকে বা ২০২৬ সালের প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে জানিয়েও তিনি বাড়তি ফ্যাসাদে।

মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়তো সম্ভব হবে। এর সঙ্গে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার যোগ করলে আরো ৬ মাস অতিরিক্ত বাগড়া। তার এ ধরনের কথার মধ্যে তবে- কিন্তু আঁচ করছে তারা। তাই তারা আরো স্পষ্টতা দাবি করে। যার জেরে পরদিন সংবাদ সম্মেলন করে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম জানান, ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে।

৭ জানুয়ারির ডামি নির্বাচন : চলতি বছরের শুরুতে অনুষ্ঠিত হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আওয়ামী লীগ সরকারের এক তরফা নির্বাচনের প্রস্তুতি দেখে তা বয়কট করেছিল বিএনপি, জামায়াতসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল। প্রতিপক্ষবিহীন নির্বাচনকে জমজমাট করতে অভিনব ‘কৌশল’ নেয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ।

নির্বাচনে সমমনা জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাকের পার্টি, বিকল্প ধারা, কল্যাণ পার্টি, তরিকত ফেডারেশনসহ ১৪ দল থেকে সমঝোতার মাধ্যমে আলাদা প্রার্থী মাঠে নামায় আওয়ামী লীগ। একই সঙ্গে নৌকা প্রতীকে নিজ দলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করায় দলটি। নিজেদের প্রতিপক্ষ নিজেরাই, নির্বাচনে নজিরবিহীন এবং অভিনব এসব প্রার্থীদের নাম শেখ হাসিনা নিজেই রাখেন ‘ডামি প্রার্থী’।

নির্বাচনি ময়দানে আওয়ামী লীগের মিত্র দল এবং নিজ দলের নেতাকর্মীদের পরস্পরের বিরুদ্ধে ‘ডামি প্রার্থী’ বানিয়ে ‘ডামি নির্বাচনের’ তরী পার হয়ে টানা চার মেয়াদের জন্য ক্ষমতা ধরে রাখতে পারলেও শেষ পর্যন্ত গদি রক্ষা করতে পারেননি শেখ হাসিনা।

এ নির্বাচনে ২২৪ টিতে আসনে জয় পায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছেন ৬২টি আসনে, জাতীয় পার্টি জয় পেয়েছে ১১টিতে, তিনটি আসনে বিজয়ী হয়েছে অন্যান্য দল-এর আগে ২০১৪ সালেও নির্বাচন বয়কট করেছিল বিএনপি-জামায়াত জোটসহ তাদের মিত্র দলগুলো। সেবার আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে। এরপর ২০১৮ সালে নিবন্ধন হারিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি জামায়াতে ইসলামী। তবে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জোট গঠন করে নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি ৩০০ আসনের মধ্যে মাত্র ছয়টি আসনে জয় লাভ করে। যদিও কারচুপির অভিযোগ তুলে এই নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে তারা।

এ বছরের ৭ জানুয়ারি মিত্র দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতার ‘ডামি নির্বাচনের’ মাধ্যমে দ্বাদশ সংসদে সরকার গঠন করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। পারস্পরিক সমঝোতায় সংসদের ‘ডামিবিরোধী দলের’ দায়িত্ব নেয় স্বৈরাচার হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের হাতে গড়া দল জাতীয় পার্টি। সংসদে বিরোধী দল হিসেবে থাকার পাশাপাশি জাতীয় পার্টি থেকে কয়েকজন আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিপরিষদের থাকার চেষ্টা করেছিল। আরো বেশি বিতর্ক এড়াতে আওয়ামী লীগ তাতে সাড়া দেয়নি।

হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন ইসির পদত্যাগ : গত ৫ সেপ্টেম্বর দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পদত্যাগ করার ঘোষণা দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

বিদায়ী বক্তব্যে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনিসহ তার কমিশনের সদস্যরা পদত্যাগ করার মনস্থির করেছেন। রাষ্ট্রপতির কাছে দেয়ার জন্য পদত্যাগপত্রগুলো ইসি সচিবালয়ের সচিবের কাছে তারা জমা দিয়েছেন।

সেদিন নির্বাচন ভবনের বাইরে একদল লোক বিক্ষোভ দেখান। তারা হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে নানা স্লোগান দেন। নির্বাচন ভবনের ভেতরে-বাইরে সেনাসদস্যদের অবস্থান করতে দেখা যায়।

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। পরদিনই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। এরপর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা শপথ নেন। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। প্রধান বিচারপতি থেকে শুরু করে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনেকে এরই মধ্যে পদত্যাগ করেন। সর্বশেষ হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন ইসি পদত্যাগ করেন।

ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন : গত ৩১ অক্টোবর নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে নাম প্রস্তাব করতে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীকে সভাপতি করে ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করা হয়।

বিচারপতি জুবায়ের ছাড়া এই কমিটিতে সদস্য হিসেবে আছেন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান, মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মো. নূরুল ইসলাম, সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান (পিএসসি) মোবাশ্বের মোনেম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার এবং বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিন্নাতুন নেছা তাহমিদা বেগম। এ কমিটি পরে কমিশনার নিয়োগে নাম প্রস্তাব করেন।

নতুন ইসি গঠন : গত ২১ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন সংবিধানের ১১৮ (১) ধারায় সাবেক সচিব এ এম এম নাসির উদ্দিনকে নতুন সিইসি এবং চারজনকে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেন।

পরে নবনিযুক্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন ও চার নির্বাচন কমিশনার শপথ নিয়েছেন। নতুন চার নির্বাচন কমিশনার হলেন- সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো: আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ আবদুর রহমান মাসুদ, সাবেক যুগ্ম সচিব বেগম তাহমিদা আহমদ এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। এ কমিশন আগামী সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত